জীবন প্রকৃতি

জীবন প্রকৃতি

মো: এনামুল হক


ছোট্ট বালক। প্রত্যন্ত এক গ্রামের অজ্ঞাত কোনো পাড়ায় তার বসবাস। বিপ্লব ছেলেটার নাম। চোখে মুখে দৃঢ়তার স্পষ্ট ছাপ। কেবলই এক বোঝা ঘাসের আটি মাথায় করে ও বাড়ির উঠানে ধপাস করে ফেললো। আদুল গায়ে চিটপিটে ঘাম আছেই। তা হলে কি হবে, পাড়ার এক সমবয়সী বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েই যেন লাফিয়ে পড়লো গলিতে। বন্ধু রুমনের ফুটবলটাকে লাথি মারতে মারতে ও নিয়ে গেল নদীর ধারের পতিত জমির এক প্রশস্ত মাঠে। বলের শব্দে ঐ পাড়াতে আর যত সব খেলার সাথীরা ওর ছিল তারাও হুড়মুড় করে এসে জুটে গেল খেলার মাঠে। দুরন্তপনার রেশে বেশ খানিক চললো এক অনানুষ্ঠানিক ধুমধাম ফুটবল ম্যাচ। অবশেষে খেলায় ক্লান্ত দুরন্ত ছেলেগুলো কড়ই তলার বিস্তীর্ণ ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। এই ফাঁকে খেলার একমাত্র দর্শক আমি বিপ্লবকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো? থ্রিতে- বলেই ও একটা স্বতঃস্ফূর্ত ডিগবাজি খেয়ে নিলো। - তুমি সকালে কি খেয়েছো? - ডাল দিয়ে রুটি- বলেই ছেলেটি আমার প্রশ্নবাণে জর্জরিত হবার আগেই ওখান থেকে সরে গেলো। আবার সে বন্ধুদের সাথে চ্যাংদোলা খেলতে খেলতে নদীর পাড়ের ঢিবি হতে একটা এক্রোব্যাটিক ঝাঁপ দিয়ে নদীর শান্ত ধারার পানিতে উল্টিয়ে পড়লো। ফলে তখন নদীর ঐ অংশটায় যেন খণ্ড আকারের এক সাময়িক অশান্ত জলোচ্ছ্বাস বয়ে গেল। আর সেইসাথে ছেলেটা ভরা নদীর পানিতে বন্ধুদের সাথে সাঁতার প্রতিযোগিতায় একটু বেপরোয়া হয়ে উঠলো। বোঝা গেলো, এই বয়সেই নব উদ্যমের ঐ তরুণ ছেলেটা সাঁতার থেকে শুরু করে জীবন চালানোর সকল রসদ প্রাকৃতিকভাবেই শিখে নিয়েছে।


একটু পরে দেখি খুঁটিতে বাঁধা নিজের দেহের মতই জীর্ণ শীর্ণ নৌকাটি দক্ষ নাবিকের মত বাইতে শুরু করে দিয়েছে ও। আমি বললাম- আমারে নিবা নৌকায়? আসেন কাকু - বলেই ও নৌকা ডাঙায় ভিড়িয়ে দিল। -এটা আমাগের নৌকা, আব্বু মাছ মারে... আমি আর সিমা আপু স্কুলে যায় আবার কারুর দরকার হলি গাঙ পার করে দিই। নৌকায় উঠে ওর সাথে খুচরা কথার ঢঙে পারিবারিকসহ নানা বিষয়ে বেশকিছু গাঢ় আলাপ শুরু হলো এবং ওর কথার সৌন্দর্যের সাথে নদী পাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রহস্যময় দ্যুতি আমার দুচোখের পর্দায় অনর্গল প্রতিফলিত হতে থাকলো। আমি লক্ষ্য করলাম, ওর কথার সাথে ঢেউ খেলছে এক রাশ সততার মিশ্রণ আর সুউচ্চ পর্বতসম আত্মবিশ্বাস এবং চোখে মুখে ফুটে আছে দৃঢ়তার অসামান্য এক ছাপ। মায়ের কষ্ট লাঘবের জন্য ও একচ্ছত্রভাবে গৃহস্থালির সকল কাজে বিচরণ করে বলে জানালো। বাড়ির এতসব কাজ আর দুরন্তপনার মাঝেও পড়াশোনার ব্যাপারে ঐপারের স্কুলের সারদের সুউচ্চ প্রসংশাও ওর রয়েছে বলে জানতে পারলাম। 


ওর মমতাময়ী মা প্রতিদিন আদর করে যে হাতে স্কুলের ব্যাগ কাঁধে তুলে দেয়; বড় অফিসার হয়ে মায়ের সেই হাতে নাকি ও সোনার বালা পরিয়ে দেবে। বাবাকেও আর এভাবে দূরের হাঁটে মাছ বেচতে দেবে না। ছোট বোনটাকে যৌতুকের নেশায় মত্ত কোন নরপশুর হাতে সে তুলে দেবেনা। ওর মত ছোট বোনটাকেও সে গড়ে তুলবে আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান এক আত্ম নির্ভরশীল শিক্ষিত মহীয়সী নারী। কারণ ও নাকি জানে নদী শুধু বয়েই চলে না, বরং সে ভূপৃষ্টের সকল গ্লানি আর অসারতা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেয় এবং সকল তৃষ্ণার্ত আত্মার পিপাসা মেটাতে মেটাতে অতল স্পর্শী সাগরে গিয়ে মিশে যায়। নদীর কুলকুল ধ্বনি তার নিত্য সঙ্গী যা ছেলেটার সুর অনুশীলনের অদম্য এক প্রেরনা দিয়ে চলে। সূর্য প্রভাতের স্নিগ্ধ আভায় উদিত হয়ে ক্রমান্বয়ে তেজস্বী বিকিরণ ছড়িয়ে তা সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় উদ্ভিদ মানুষের রিজিক উত্পাদনের অনুষঙ্গী হয়ে অবশেষে তা অস্ত যায়। আবার পৃথিবীর ঐ রাত নামক আপন কালো ছায়ার স্নিগ্ধতায় অংশ নিতে সূর্যালোকের চাদর গায়ে মেখে চাঁদও কবির কলমে প্রসংশা কুড়াতে হাজির হয় আপন মহিমায়। তাই প্রকৃতির এত মহানুভবতার মাঝে লাউয়ের ডোগার মত তরতর করে বেড়ে ওঠা ছোট্ট বালকের তাবত পৃথিবীর যত সত্ আত্মা আছে তাদের মত উদার না হওয়ার কোনো উপায় আছে? সেখানে কোকিলের কুহুতানে পাল্লা দিয়ে সে সুর মিলিয়ে মজা লয়। কবির চোখের সৌন্দর্য ঐ শিমুল ফুলে শালিকের খাদ্য অন্বেষণ যা অবশেষে সেই ফুলগুলোই আবার বালকের ঝুড়িতে গবাদি পশুদের খাদ্য খোরাক এ যেন মন আর পেটের খোরাকের এক অনন্য সমন্বয়ক। ঘন সবুজের বুকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে থাকা তিল,শস্য আর সোনালী ফুলের অবারিত সৌন্দর্য ঝংকারে সংগ্রামী মৌমাছির মধূ সংগ্রহ দেখা বালকের মুগ্ধ নয়ন যুগল সেতো নিজের সৌন্দর্যের মধূ বিলাতে একটুও কার্পণ্য করে না। কঠোর শৃঙ্খলায় আবদ্ধ পিপীলিকার নিজের ওজনের বিশ গুন বোঝা বহনের অসামান্য কৃতিত্ব আর মজেজায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বালক বিপ্লবের পাহাড়সম অটুট বিপ্লবী মনোভাবের উদয় হবে এটাই স্বাভাবিক। নিজ সামর্থ্য, দক্ষতা এবং সৃজনশীলতায় বাবুই পাখির সূক্ষ্ম বুননে বাসা বানানোর ঐকান্তিক শিল্প চর্চা দেখে দেখে বড় হওয়া কচি মনে শিল্প রশনা জেগে ওঠাটা তো কোনোভাবেই অস্বাভাবিক নয়।


রাজধানীর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া আমার টিউশনির এক ছাত্রের 'ধান গাছ কেমন' এমন প্রশ্নে যার পর নাই অবাক হয়েছিলাম। কেননা কল্পনা চিত্তের গহীন মানসপটে ক্ষুদ্র ধান গাছের অবয়বকে অতি বৃহত্ বটবৃক্ষের আকৃতিতে চিত্রায়ন শুধু বিস্ময়করই নয় বিরক্তিকরও বটে। পরে এই ভেবে মনে শান্তনা নিলাম যে পরিবেশ তাকে টবে থাকা বনসাই করে রেখেছে এতে ওরই বা এত দোষ কিসের! বইয়ের বোঝা মাথায় নিয়ে শুধু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের স্বপ্ন তাকে শুধুই যন্ত্র করে রেখেছে, প্রকৃত ছাত্র হতে দেইনি কখনো। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাবাকে সে টাকা উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবেই চেনে জানে। ব্যতিক্রম যে নেই তা বলব না, তবে অধিকাংশের মননশীলতায়ই তাদের আশেপাশের ঘটনা প্রবাহের স্পষ্ট একটা ছাপ প্রকট ভাবে থেকেই যায়। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, করপোরেট কালচার সবই তাদের হাতের মুঠোয় থাকায় ধূমপান, মদপান, পর্ণ্যগ্রাফিতে আসক্তি সবই নাকি তাদের স্মার্টনেসের তালিকায় স্থান করে নেয়। ফলে ধীরে ধীরে এরা ধর্ম চর্চায় অনীহা সম্পন্ন আর নৈতিকতা বিবর্জিত এক গ্যাঙ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক প্রজন্মে রূপান্তরিত হয়।


অন্যদিকে বদ্ধ ছায়াযুক্ত জায়গার চেয়ে উন্মুক্ত স্থানে বেড়ে ওঠা মরিচের চারাগুলো যেমন রোদ, বৃষ্টি আর খরায় শক্ত হয়ে বেড়ে ওঠে, ঠিক তেমনি বেড়ে ওঠা বিপ্লবের। শহুরে আলালের ঘরের দুলালের মত গায়ে গোস্ত লাগিয়ে কম্পিউটার, মোবাইল গেমে সে আসক্ত নয়। নেশার ঘোরে মা-বাবাকে গালি দেবার পাত্রও সে নয়। ইট- পাথরের বিলাশী বাড়ি আর কংক্রিটের রাস্তা বুকে নিয়ে সদর্পে বেড়ে ওঠা শহরের অলিগলিতে এখন নাকি ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অনেক সহিংস ত্রাস সৃষ্টিকারী কিশোর গ্যাঙ। কাদায় ঘেরা প্রকৃতির নরম স্নিগ্ধ পাঠশালায় অঙ্কুরিত বিপ্লবেরা ঐখানে যোগ দেওয়া তো দূরের কথা 'কিশোর গ্যাঙ' শব্দটাই হয়তো কোনোদিন শুনে নাই। বরং জমিজমা আর সম্পদ নামক হিসাবের খাতা শূন্য থাকা স্বত্তেও সে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে পিতা-মাতার খেদমতে সদা চঞ্চল। অসীম আকাশের মত উদার হয়ে ছোট্ট ছেলেটা বাবার দেখাদেখি এই বয়সেই অবচেতন মনের স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিমায় শিখে নিয়েছে নৌকায় মানুষ পার করা হতে শুরু করে পরোপকারের নানা অভূতপূর্ব পন্থা । স্বার্থ চিন্তা বাদ দিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় সাধনা মানব উপকারে সর্বদা ব্রত থাকায় যেন তার প্রথমসারির অগ্রাধিকার মুলক কাজ। তাই এটা আমার এখনো বুঝে আনতে খুবই কষ্ট হয়, মানুষ কেন যে এখনো শান্তির নির্ভেজাল আবাস প্রকৃতির অপার ময়দান ছেড়ে কৃত্রিম ইট পাথরের দয়ামায়াহীন খোপে রঙিন জীবনের বাসা বাঁধতে দিনরাত্রি এত ব্যস্ত সময় পার করে।

Comments