কঠোর লকডাউন

কঠোর লকডাউন 

মো: এনামুল হক 


"মা আপনার বাড়ি কোথায়?" বলতেই মা বয়সী বৃদ্ধা লোকটি পেছন ফিরে চোখ ছলছল করে আমাদের দিকে তাকালো। -ঐ নদীর ধারে! এ কথাটি বলতে বলতে নিজেকে সামলে নিয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় কুঞ্চির লাঠির উপর ভর করে নড়বড়ে ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন বৃদ্ধা মা। হয়তো এক পেট ভাতের জন্য এই বৃষ্টি ভেজা বিকালেও উনি দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। -আপনার ভোটার আইডিটা নিয়ে আইসেন তো মা। আপনার নামে কিছু খাদ্য সামগ্রীর ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখবো ইনশাল্লাহ। এই পথেই প্রতি দিন আমরা অফিসে যাই। আপনি আগামীকাল সকালে আইডি কার্ডটা আমাদের হাতে দিতে পারবেন? কৃতজ্ঞতার আধিক্যে ভারি ভারি কণ্ঠে বুঁদ হয়ে বৃদ্ধ মা বললেন, কেন পারব না বাজান। আমি ঠিক নিয়াসপানে আর এই মোড়েই বসে থাকপানে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি চাতুর্যতায় একই ছাতার তলে আমিও আমার ম্যানেজার সারের সাথেই ছিলাম আর সামান্য সাহায্যের আশ্বাসে শীতল চক্ষুর উচ্ছলতাকে খুব কাছ থেকে আপন মনে অবলোকন করছিলাম। এতো তো গেলো দৈবাত্ সামনে পাওয়া শুধু একটি অসহায় মায়ের প্রাত্যহিক জীবন-গল্প যা বাস্তবিক অভিজ্ঞতার খুব কাছ থেকে আচ করতে পারা। এরকম হাজারো অসহায় মা-বাবা বাংলার ঘরে ঘরে নিরবে নিভৃতে বাস করছে যাদের খবরই হয়তো আমরা কেউ জানি না।বেঁচে থাকার সংগ্রামে মানুষ যে কত অসহায় তা এরূপ কঠোর লকডাউন না আসলে হয়তো জানাই হতো না। এহেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রঃ) এর কথা মনে পড়ে গেল। আর কেন তিনি নিজের পিঠে আটার বস্তা বহন করে অনাহারীর মুখে খাবার তুলে দিতেন তার কারণটাও আজ হাড়েহাড়ে উপলব্ধি করতে পারলাম। নিজের হাতে অনাহারীর মুখে খাবার তুলে দিতে পারা; কত যে তৃপ্তি কত যে প্রশান্তি তা ভাষায় প্রকাশ করা না গেলেও মর্মস্পর্শী প্রশান্ত হৃদয়ের গহীন থেকে তা উপলব্ধি করতে পারলাম। আহা! এরকম ওমরসম উদার হস্তে আমাদের সাহায্য গুলো যদি এমন প্রকৃত মানুষ গুলোর হাতে হাতে পৌঁছে যেতো! তাহলে হয়তো আমরা পেতাম এক শান্ত স্নিগ্ধ পৃথিবী যেখানে ছাইচাপা আগুনের মতো ক্ষুধাগুলো এমন দগদগে অঙ্গার হয়ে আর জ্বলতো না। মায়ের ভাত রান্নার কৃত্রিম আশ্বাসের দিকে ক্ষুধা চোখে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকা সেই ঘুমন্ত শিশুর চোখের কোণে অশ্রু গড়ানো শুকনো দাগ আর দেখা যেতো না। 

যাইহোক, চলতি পথে এদিকে আবার রাস্তার মোড়ে কামলা শ্রমিক গুলোর দরিদ্রময় অসহায় ফ্যালফ্যালে শুকনো চোখগুলো মনের অজান্তেই হৃদয়ের গহীনে নাড়া দিয়ে যায়। কর্মহীন ঠেলাগাড়ি চালক সিক্ত হৃদয়ের জীর্ণ পোশাকের দেহটাকে কংক্রিটের রাস্তার আইল্যান্ডের ধারে রেখে স্থির দৃষ্টির অলৌকিক চিন্তায় একনাগাড়ে পান চাবিয়ে যাচ্ছে। এরূপ কঠোর লকডাউন না থাকলে হয়ত কর্ম চঞ্চলতায় ভরপুর এসব কর্মঠ ব্যক্তিদেরও ত্রাণ বিতরণের সংবাদটা দেবার জন্য খুঁজে পাওয়া খুবই দূরহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতো। 


অতঃপর নির্দিষ্ট দিনে আমাদের কর্মস্থলে ত্রাণ বিতরণ শেষ হবার পর কোথায় যেন খবর পেয়ে ভোটার আইডি বিহিন এক পাকা দাড়িওয়ালা লোক তালাবদ্ধ কেচি গেটের সামনে গুড়ো ধুলোর টাইচের উপর হাঁটু গেড়ে বসে গিয়েছে। ত্রাণের বস্তা ছাড়া সে কিছুতেই বাড়ি যাবে না। এ যেন লকডাউনের উপর লকডাউন তার উপর অপরাজিত স্বত্বার অসহায়ত্বের অযাচিত নিলডাউন। এরপর অফিসের সিসি ক্যামেরা ফুটেজে আমরা আরো দেখতে পাচ্ছি, বৃদ্ধ লোকটি বাদেও সাত আট জন অর্ধ বয়স্ক মহিলা মেইন রাস্তার গেটের সামনে জটলা পাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। তবে এরা ভোটার আইডি সাথে নিয়ে ত্রাণ পাবার সব শর্ত মেনেই এসেছে। তবে এমন পরিস্থিতি হতে পারে এমন অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখেই কিছু অতিরিক্ত ত্রাণ সামগ্রী ভিতরে মজুদ রেখে দেওয়া হয়েছিল। এরপর ওখান থেকে সবাইকে কিছুনা কিছু দিয়ে তাদের অন্তত হাসিমুখে বিদায় করা গেলো। কিন্তু ক্ষুধা পীড়িত দরিদ্রময় পৃথিবীর বেখেয়াল রূপ দেখে আমার হৃদয়ের গ্লানি তখনও গেল না। 

অফিস থেকে বের হলাম। বাইরে দেখি যানবাহন বিহিন সুন্দর চকচকে কংক্রিটের পৃথিবীর ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য। কিছু দোকানদার এই কঠোর সাটডাউনেও দোকানের সাটার অর্ধনমিত রেখে বিচলিত বদনে কাস্টমারের খোঁজে ব্যাকুল। মাঝে মাঝে প্রশাসনের সাড়াসি অভিযানে লাভের চাইতে হয়তো দশগুণ বেশি জরিমানাও গুনতে হচ্ছে তাদের। এদিকে দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়ানো ভিক্ষুকগুলোও যেন মাচা বিহিন পুঁইশাকের লতির মত এদিক সেদিক ঠেল খেয়ে বেড়াচ্ছে। হুইল চেয়ারে বসে সাহায্য চাওয়া সেই প্রতিবন্ধী লোকটাকেও আজ দেখছি না রাস্তার ঐ মোড়ে। করনা নামক অদৃশ্য জুজুর ভয়ের সাথে পুলিশ প্রশাসনের ভয় সবাইকে কেমন জানি গুটিয়ে রেখেছে। স্বতঃস্ফূর্ত ভাব কোথাও নাই। লকডাউনের প্রভাবে বিয়ে জন্মদিনের অনাড়ম্বরতায় ঐ সংশ্লিষ্ট দোকানের সামনে জনতার কোনো ভিড় না থাকলেও আছে সামনে স্তূপীকৃত উচ্ছিষ্টের মাঝে খাবারের খোঁজে কিছু চড়ুই পাখির মাতামাতি। টাকার আসায় কৃত্রিম হাসিতে ঝুলে থাকা বাসী ফুলগুলোও আজ সুবাসের বদলে কেমন জানি উগ্র গন্ধ ছড়াচ্ছে। রেলগেটের সামনে একান্ত নিরুপায় এক রিকশাওয়ালা তার রিকশার যাত্রী সিটে পা মেলিয়ে দিয়ে বসে লম্বা টানের বিড়ির ধোঁয়ায় টেনশন নিরাময়ের দাওয়াই খুঁজছে। হয়তো তার এই ধোঁয়ার আড়ালের অপলক স্থির দৃষ্টিতে ভাসছে অসহায় পরিবারের এক অনাহারী আর্তনাদের করুন চিত্র। 


ভুল পথে চালিত হয়ে দুই হাতের কামায় স্বরূপ হয়তো রোগ-শোক-জরা-মৃত্যু এগুলো প্রভুর তরফ থেকে আসে আমাদের সতর্কতা বা পরিক্ষার জন্য বা বিভিন্ন কারণে ভাঙা সম্পর্কগুলো আবার মিলেমিশে একাকার হবার জন্য। তাই আসুন, মহামারীর এই মুমূর্ষু সুযোগে মানবতার জয়গানে পৃথিবীকে সৌহার্দ্য সম্প্রীতি আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সাজিয়ে তুলি এক অপার প্রশান্তির নিগূঢ় স্বর্গালয়ে!

Comments