সিলেটে প্রথম দিন (ভ্রমণ কাহিনী)
সিলেটে প্রথম দিন (ভ্রমণ কাহিনী)
মোঃ এনামুল হক
০৪/০৪/২০২২। বন্ধু আলী হোসেনের ভাড়া বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম । এই বাড়িতে মালিক থাকেনা। অনেক আগে নাকি লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন তারা। এই বাড়িটা একটা টিলার উপর অবস্থিত। তবে বড় একটা লিচু গাছ থাকায়, এই টিলাটা "লিচু টিলা" নামেও পরিচিত । মুকুল সমৃদ্ধ সেই লিচু গাছটাও আজ ঘুরে দেখলাম। এরপর গেট দিয়ে বাইরে তাকাতেই বোঝা গেল সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার অপরিসীম বৈচিত্র্যময় রূপের নিদারুণ ঝলকানিতে কেবল উঁকি মারা শুরু করেছে। সত্যিই তাই। সামনে এগোতেই দেখি এক টিলার গায়ে তারকার মতো নাম না জানা অসংখ্য সাদা সাদা ফুল সবুজ পাতার ভিতরে মুখ লুকিয়ে মিটিমিটি করে দ্যূতি ছড়াচ্ছে। কৌতুহল বশত রাস্তা ছেড়ে আমি একটু টিলার বুক বেয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করলাম। উঠে দেখি স্রষ্টার অপার সৃষ্টি সেই ফুলগুলো জোনাকির মতো সহাস্যে সারা বাঁশ বাগানের কোল জুড়ে একেবারে লুটিয়ে পড়েছে। তাই এমন একটা অন্তিম তারার মেলায় নিজেকে স্মৃতিময় করে না রাখলে কি চলে? তাই তত্ক্ষণাত্ পকেট থেকে জলদি ক্যামেরাটা বের করেই ফটাফট কয়েকটা সেলফি তুলে নিলাম। ওখান থেকে নিচে নেমে আর একটু এগোতেই দেখি লাউ, কুমড়া আর সিম লতার মাচাং । কে যেন অতি যত্নে সেগুলির পরিচর্যার দায়িত্ব নিয়েছে। পাশেই পাহাড়ি বাঁশের সুউচ্চ ঝাড়গুলো যেন পরম মমতায় সেগুলো পাহারা দিচ্ছিল। রাস্তার ডান পাশে দিয়ে আরেকটা শাখা রাস্তা বের হয়ে গেছে। সেই রাস্তায় ঢুকতেই বিচিত্র সব সুন্দরের লীলাভূমি চোখে পড়লো। সবুজ ঘাসের গালিচার উপর বনফুলের আস্তরণ মেখে মনটা যেন মুহূর্তেই অতি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। সবুজ পাতার মাঝে গোলাপী ফুলের পাপড়ি যেন অচ্ছুত প্রেয়সীর মতো অকৃত্রিম চুম্বন বুলিয়ে দেওয়ার জন্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে। লালমাটির টিলাগুলোর পাশ ঘেঁষে সামনে এগুতেই দেখি ভগ্ন দেহ নিয়ে বেড়ে ওঠা একটা উস্তে গাছের মাচাং। এর সাথে লেখা মাশাআল্লাহ। এরপর যতগুলো মাচাং দেখেছি প্রত্যেকের সাথেই ঐ শব্দগুলো জুড়ে দেওয়া আছে। আরেকটা বিষয় এখানে পরিলক্ষিত হল সেটা হচ্ছে, প্রত্যেক বাড়ির সাথে একটা করে পুকুর। আর সবুজ পানির পুকুর যেন প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এবার চোখে বাধল নন্দিত বনফুলের অতিরঞ্জিত সৌন্দর্য তুলতুলে দেহের খাঁজে খাঁজে একটা বৃন্তে পাঁচ-ছয়টা গুচ্ছ পাতা নিয়ে যেন চিরল দাঁতের হাসির ফোয়ারায় মুক্ত ঝরাচ্ছে। পাঁচ অথবা ছয় ইঞ্চি গাছের একদম মাথায় সাদা আর গোলাপী রঙের মিশ্রণে ফুটন্ত পাপড়ির মাঝে মাঝে মাগুর মাছের দাড়ি সদৃশ তন্তুগুলো যেন বিমোহিত সৌন্দর্যের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে ভাসছে। সুপরিকল্পীত ফুল চাষের মাধ্যমেও সর্বত্র এমন লাস্যময় হৃদয় সিঞ্চিত ফুলেল সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা যায় কিনা তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ থেকেই যায়। এত সৌন্দর্যের দরিয়ায় দড়িতে বাঁধা একটা ভেড়ার বন্ধি অবস্থায় দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমাকে দেখে অবশ্য ভেড়াটি আনমনে ছোটাফাটা লাগিয়ে দিল। ওদিকে পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে সবুজ গাছ গাছালির প্রতিচ্ছবি আর বনফুলের স্নিগ্ধ মাথা দুলানো নাচ, অনুভূতিসম্পন্ন যেকোনো মানুষের হৃদয় আঙিনায় রোমাঞ্চের উত্তাল ঝড় না তোলাটা সত্যিই দুষ্কর একটা ব্যাপার।
কথা বলছিলাম কানিশাইল, মেইন রোডের পাশে, ঢাকাদক্ষিণ গোলাপগঞ্জ, সিলেট অঞ্চলের কথা। এখানেই থাকে আমার প্রিয় ছোট বেলার বন্ধু আলী। বন্ধুকে ছাড়াই আমি আশপাশের এলাকাটা একটু ঘুরে দেখছিলাম। তাই দেখে মনে হলো, অখ্যাত স্থানই যদি এত সৌন্দর্যের আঁধার হয়, তাহলে পর্যটনময় পুরো সিলেটের নান্দনিক সৌন্দর্য কত অবারিত সৌন্দর্যের আঁধার তা সহজেই অনুমেয়। আনমনে চলতে চলতে আরেক বাড়িতে দেখি, চাষ করা আনারস গাছের মাথায় নতুন বরের মুকুটের মতো আনারস কেউ যেন যত্ন করে বসিয়ে রেখেছে। আবার ঐ বাড়িরই একপাশে দেখি সুপারি পাতায় ঘেরা ঝুপড়ি একটা বেড়া দেওয়া। এতে বোঝা গেল, পর্দার সাথে গোসল করার জন্য পুকুরের মাঝে এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এখানকার মেয়েরা নাকি পর্দা স্বরূপ সব সময় ছাতা মাথায় স্কুলে যায়। সামনে আর একটু এগোতেই দেখি, বাগানবিলাস ফুলের অনিন্দ্য সৌন্দর্যের স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ। এর সামান্য দূরে দুই টিলার মধ্যবর্তী অল্প নীচু যায়গায় নীল সবুজ মাঠের পাশে যেন সবুজ বৃক্ষরাজি মাথা দুলিয়ে সেই সৌন্দর্য আপন মহিমায় পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। আর সেই সৌন্দর্যের আহবানে আমিও ঘাসের সবুজ গালিচার উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। মহান স্রষ্টার ঐ থরে থরে সুসজ্জিত প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভুমি দর্শনে দুচোখ বেয়ে যেন নেমে এলো প্রশান্তির স্বস্তি। আবার পাশের আরেকটি টিলা অভিমুখে উঁকি মেরেই দেখি পুরো টিলায়ই আনারসের চাষ। ওর পাশেই সম্ভবত এক আনারস চাষী তার এক গাভী গরুকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত সময় পার করছে। আমার ছবি তোলা দেখেই মনে হয়, এক লালচে জাতের পাকরা ছাগল তার সৌন্দর্যের ছবি ক্যামেরাবন্দি করার জন্যই হয়ত আমার সামনে এসেছে। আমার সামনে এসে ঐ অবুলা রোমান্টিক ছাগলটি দারুন একটা পোজ নিয়ে দাঁড়ালো। একটা ছবি তুলে আমিও তার শখ পূরণ করতে একটুও কার্পণ্য করলাম না। পাশেই এক কমিউনিটি সেন্টারের আঙিনার পাশে "রঙিন জবা ফুল' ফুটে রয়েছে দেখলাম। তা দেখে তত্ক্ষণাত্ আমার ছোট বেলার সেই আবৃতি করা ছড়া "ঝুমকো জবা বনের দুল, উঠলো ফুটে বনের ফুল.... " কবিতার কথা মনে করিয়ে দিল । যাইহোক, আরেক বাড়ির পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখি ছোট্ট একটা "বিচালি পালা" সযত্নে স্মৃতি সৌধের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এর ছবি দেখে বন্ধু আমার তথ্য দিল, এখানকার চাষীরা নাকি ইরি আবাদ করে না। আষাঢ় মাসের প্রাকৃতিক বৃষ্টিতে যেটুকু ফসল ফলে শুধু ওইটাই ওরা চাষ করে থাকে। আমাদের এলাকার মতো এখানে এথা সার, কীটনাশক দিয়ে ফসলকে অত জামাই আদর করে না।
যাইহোক,আরেকটু দুরে এগুলে দেখতে পাই, বাচ্চা নিয়ে একটা তরতাজা মুরগি ঘাস, পোকামাকড় খেয়ে বেড়াচ্ছে। ওহ ভালো কথা, এইখানে নাকি মোরগ লড়াইয়ের প্রতিযোগিতা হয় প্রতিনিয়ত। এমনকি ষাঁড়ের লড়াইও হয় প্রতিবছর। কথা বলে মনে হলো, মানুষ গুলো এখানে খুবই শান্ত প্রকৃতির। ষাড় লড়াইয়ে যারা জিতে যায় তারা নাকি ঢোল ডগর আর সানাই বাজিয়ে আনন্দ ফুর্তি করে থাকে। শুনলাম, এখানে অনেকটা সামাজিক মাতব্বরের বিচার চালু আছে এখনও। কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে জরিমানার অর্থ গুনতে হয়। তবে এখন রাজনীতি বা আকাশ সংস্কৃতির করাল গ্রাসে সামাজিক রীতি নীতির অনেকটা পরিবর্তন হচ্ছে। সামনে এগুতেই বিকেলের স্নিগ্ধ বাতাসে দেখি দুই বৃদ্ধ পরম ফুরফুরে মেজাজে খোশগল্পে মেতে আছে। সিলেটি ভাষায় অভ্যস্ত না হওয়ায় আমি তাদের কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না । যাইহোক, আসরের নামাজ পড়তে যাব বলে এক লোকের কাছে মসজিদের কথা জিজ্ঞাসা করতেই উনি আঙ্গুল উঁচু করে দেখিয়ে দিলেন মসজিদের অবস্থান। রোজায় থেকে হাঁটতে হাঁটতে একটু ক্লান্তই হয়ে গেছিলাম। তাই মসজিদের অতটুকু দূরুত্বের পথ আমার কাছে অনেক পথই বলে মনে হলো। তবে মনের জোরে মসজিদ পানে ধীরে ধীরে চললাম। সামনে গিয়ে দেখি ছোট-বড় নানা বয়সের মানুষ রংবেরঙের টুপি মাথায় দিয়ে আসরের নামাজ পড়তে যাচ্ছে। আর ওই দৃশ্যটা যে আমার কাছে কত মধুর লাগলো, তা বলে বুঝাবার নয়! ওদের সাথে চলতে চলতে পথিমধ্যে একটা ডাব আলার হাত থেকে একটা ডাব পাশের পুকুরের মধ্যে পড়ে গেল। সবাই ওকে ডাব তুলতে সাহায্য করল। যাইহোক, এরপর আমি দেখি পাশেই আরেকটা পুকুরে মুসল্লিরা সবাই নামাজের জন্য অজু বানাচ্ছে। আমিও তাদের সাথে অজু বানাতে শরিক হলাম। এরপর আমি নামাজ শেষ করে, আবারও প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করা শুরু করি। যে লজ্জাবতী ফুল আমরা এখানে টবে চাষ করি, সেটা রাস্তার ধারে এমনিতেই অতি সৌন্দর্যের মায়ায় জড়িয়ে কত লজ্জার আবরণে অবগুণ্ঠণ করে আছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সাধারণ কচুপাতা এবং রঙিন কচুপাতা গুলো একসাথে যেন গলাগলি করে আছে। এক বাড়ির সামনে প্রায় দশ ইঞ্চি উচু "বেতের শাক" আমাকে আশ্চর্য করল। কারণ এর আগে এতবড় বেতের শাকের গাছ আমি কখনো চোখেই দেখিনি। আর উল্লেখ্য, সেখানেও "মাশাআল্লাহ" শব্দটি সমহিমায় লেখা আছে।
Comments
Post a Comment