মুয়াজ্জিন দুর্দশা
মুয়াজ্জিন দুর্দশা
মোঃ এনামুল হক
আমি দেখেছি সব ক্ষেত্রে মানুষের বেতন বাড়ে। কিন্তু গ্রাম অঞ্চলে যে সমস্ত মোয়াজ্জিন মসজিদে আজান দেন, তাদের সম্মানী কখনোই বাড়ে? বাড়ে না। বরং প্রকারান্তরে বা আপেক্ষিক ভাবে তা আরোও কমতে থাকে যা ভুক্তভোগীদিগকে খুবই প্যারা দেয়। আমার গ্রামের বাড়ির পাশেই একটা মসজিদ আছে। সেই মসজিদে একদা এক জীর্ণশীর্ণ রোগা মোয়াজ্জিন ছিল। উনি সম্পর্কে আমার নানা হন। সেই নানা সবসময় মসজিদের মেঝে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করতো; কিন্তু বয়সের ভারে সেটা আর সব সময় অতো সুচারুভাবে হয়ে উঠতো না। অথচ এই জিনিসটাই যখন ঐ এলাকার এক মধ্যবয়সী গোছের টিপটাপ বক-ধার্মিক লোকটা এসে দেখতো; তখন সে ঐ নানাকে কী তাড়ানোই না তাড়াতো। লোকটার এই তাড়নজাত ধ্বনির উত্স সম্ভবত, কালেভেদ্র জুমার দিন পাঁচ টাকা দান অথবা বছর অন্তে অনুরোধের ঢেকি গেলা স্বরূপ পাঁচ কেজি ধানের বনেদি অবদান। বিবেক- বিবেচনাহীন গাধার মত কর্কশ কণ্ঠে এমন তাড়ানো দেখে আমার মাঝে মধ্যে খুবই বিরক্ত লাগত। শুধু তাই নয়, চকচকে টাইলসের মেঝের কোনো এক কোণে হয়তো অদেখা অস্পষ্ট কোনো ধুলো দৈবাত্ তার চোখে এসে ধরা পড়েছে; আর অমনি তার ডিম পাড়া মুরগির মত লাল ছানাবড়া চোখটা উল্টে একেবারে পেছনে চলে যেত। উন্মুক্ত বারান্দার মেঝের মাটিতে হঠাত্ কোন মুরগিও যদি উড়ে এসে বসেছে; সেই দোষের রেশটাও মোয়াজ্জিনকে আচ্চারকম ধুলায় দিয়েই ক্ষান্ত হতো। অথচ দামি হাদিয়া দানের ভয়ে ন্যূয হয়ে এই সস্তা অকর্মণ্য মোয়াজ্জিনটাও তারা কখনো ছাড়তে চায় না। সাবান কেনা টাকা না দিলেও ওযুর পর হাতমোছা ময়লা গামছাটা দেখে মুখটা এমন বিশ্রীভাবে চেদরিয়ে ফেলে যেন রাজ্যের আবর্জনা ভর্তি ভরাট জিহ্বাটা তার দুর্গন্ধ যাতনায় দম বন্ধ হয়ে মরতে বসেছে। কেনা তো দূরের কথা ; হারপিক, ব্লিচিং পাউডার বা অডোনীলের নামও হয়তো কখনো শোনেনি, অথচ সেগুলোর অলৌকিক প্রত্যাশায় টয়লেট বাথরুম স্বর্গীয় দ্যূতিতে সৌরভময় দেখতে প্রাণটা লকলক করে ওঠে তার। তাই অতিষ্ঠ তাড়া খাওয়ার তীব্র বিষে নানার মুখটা অধিকাংশ সময়ই যেন মলিন হয়ে থাকতো। সে মনে মনে হয়তো ভাবতো, এ কথার উত্তর যদি দিই, তাহলে আমার অন্ধের যষ্টির মত কাজের এই বাসনাটা তো নাও থাকতে পারে। এজন্য নানা অনেক কিছু ভেবে চিন্তে তার মনের ক্ষোভের কথাগুলো সবার কাছে অবলীলায় বলা থেকে বিরত থাকত। সে ভাবতো, তার বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান আছে আর কাঁধে আছে তার বিয়েযোগ্য মেয়েদের পাত্রস্থ করার নানা দায়িত্ব। বছর শেষে যেটুকু ধান-টান পায় অথবা পরের দুয়ার মেগে যতটুকু সে চাল-খাবার পায়, সেটা দিয়েও অন্তত ক্ষুধার জ্বালাটা সে নিবারণ করতে পারে। কিন্তু কারো কথার উত্তর দিয়ে যদি তার কাজটা আর না থাকে। তাহলে তার পরিবারের কি হবে? এই ভেবে সে অনেক খারাপ কথার উত্তরও কখনো দিতে চায় না। নির্বিকার থাকে। কিন্তু আমার জানামতে ঐ নানা জোয়ান কালে কিন্তু খুবই বদ মেজাজী ছিল। এখন বৃদ্ধ বয়সে এসে, উনি যেন তার দায়িত্বের কাছে সব তেজগুলো একদম হারিয়ে ফেলেছেন। পরের ক্ষেতে হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে করে নব-যৌবনের সমস্ত শক্তি ক্ষয় করে, শেষ বয়সে এসে স্ত্রী কন্যাদের মুখের দিকে চেয়ে সে মোয়াজ্জিনের দায়িত্বটা কাঁধে তুলে নিয়েছেন; যাতে করে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে কোনো রকম খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা যায়। একসময় কোনো শক্ত ব্যক্তিও তার নামে দুটো কটু কথা বলার ক্ষেত্রে সাত বার ভেবেছে। অথচ একন এমন কথা কোনো নগণ্য ব্যক্তির কাছ থেকেও উনি অমলিন মুখে সহ্য করে চলেছেন। সে যখন আযান দেয় হয়তো বার্ধক্যের কারণে আযানের কিছু শব্দ এলোমেলো হয়ে যায়। এটা দেখে অনেক মানুষ হাসাহাসি করে। তাকে দায়িত্বে আর রাখবে না বলে হুমকি দেয়। অথচ তিনি নির্বিকার ভাবে মসজিদের বারান্দায় আঁকড়ে ধরে এর ওর কাছ থেকে ভুল শব্দগুলো কোনরকম প্র্যাকটিস করে হলেও সেটার দায়িত্ব কখনোই ছাড়তে চায় না। নেশার মতন লেগে থাকে। দেখেছি কিছু মানুষ যাদের বাড়ি হয়তো কোন ফ্যানই নেই। তারা মসজিদে এসে মুয়াজ্জিনকে দিয়ে ফ্যান ছেড়ে তা এমন ভাবে উপভোগ করে যেন মনে হয় এটা তার বাপ দাদার কোনো নিজস্ব সম্পত্তি। অথচ এক্ষেত্রে সে নিজেও অন্তত ফ্যানের সুইজটা দিয়ে বসতে পারতো। অথচ নিজে না দিয়ে বেকুবের মত মোয়াজ্জিনকেই হুকুম করে ফ্যানটা ছেড়ে দেয়ার জন্য। যেটা বিবেকবান লোকদের কাছে খুবই দৃষ্টিকটু লাগে। আবার বিভিন্ন ধরনের কটু কথার বিষ তাকে হজম করতেই হবে। আবার দলমতের ভিন্নতার কারণে সময়ে সময়ে তার ঐ সংশ্লিষ্ট মতের উপরেই জীবন কাটাতে হবে। এ এক নির্মম আচরণ তার প্রতি। যেটা না দেখলে হয়তো কেউ বুঝতে পারবে না যে, একটা গ্রাম্য মোয়াজ্জেন কতটা অবেলায় তার জীবনাতিপাত করে। এমনও দেখেছি, পাশের গ্রামের একটা মসজিদের মোয়াজ্জেমকে যিনি আরেক গ্রাম থেকে সাইকেল বেয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে প্রতিদিন আসতো ফজরের সময়। পাঁচ ওয়াক্ত আজান আকামত সহ আনুষঙ্গিক কাজ সেরে আবার এশার নামাজ পড়ে বাড়ি চলে যেত। আবার কোন কোন দিন ঝড় বৃষ্টি হলে মসজিদেই রাত যাপন করত। তারও আবার বাড়ি বাড়ি চাল তুলে পেটের খোরাক জোগাড় করতে হতো। এই দিয়েই কোনোরকম তিনি তার পরিবারের মুখে আহার তুলে দিত। অবশেষে জানতে পেরেছি, মসজিদের মাটিতেই সেজদা রাখা অবস্থায় একদিন চিরসুখের খাটলায় লোকটি চিরবিদায় নিয়ে চলে যায়। কোনরকম দ্বিধাবোধ না রেখেই অতি যত্নে সতী-সাধ্বী স্ত্রীর পরিবারকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় তিনি এই কাজটা নিয়েই সারাক্ষণ পড়ে থাকতেন। শুনেছি সে নাকি মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিল। যাইহোক, এটা আমাদের কাছে কেন বোধগম্য হয় না যে; গ্রামে একেতে কোন উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোয়োজ্জেম পাওয়া খুবই কষ্টকর হয়ে যায়। আবার তারপরেও এই সমস্ত বক ধার্মিক মানুষগুলো কেন যে এদের উপরে এতো স্টিমরোলার চালায় সেটা কোনো ভাবেই বোধগম্য নয়। এরপর আমরা দেখেছি, অনেক মানুষ অনেক অরগানাইজেশনে চাকরি করলে সে চাকরির ক্ষেত্রে প্রমোশন হয়, ইনক্রিমেন্ট হয়, বোনাস পায়, উৎসব ভাতাসহ অনেক কিছুই হয়। কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বে রত এই মানুষগুলোর কাছে এটা এমন একটা চাকরি যেখানে তাদের সম্মানী বাড়ানো তো দূরের কথা; পারলে আরেকটু কমিয়ে দিলেই বোধ হয় খুব ভালো হয়। আবার যতটুকু সম্মানি পায় সেটার বিনিময়েও কিছু লোক তাদের দিয়ে অনেক বেশি কাজ করিয়ে নেওয়ার পৈশাচিক চিন্তায় মত্ত থাকে। আজান-আকামত ছাড়াও মসজিদ উন্নয়নের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল তুলা, টয়লেট ওজুখানা পরিষ্কার, পাপোশ, কার্পেট, টাওয়াল, জায়নামাজ পরিষ্কার, প্রতিদিন ঘর মোছা, টাকা আদায়সহ, দোয়ার অনুষ্ঠান, ইফতার পার্টি, ঈদ ও জানাজার নামাজ বা জুমার দিনে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে তার দায়িত্ব পালন করতে হয়। ঠিকঠাক মত আবার না করতে পারলে; তার জন্য আবালবৃদ্ধবনিতার অপরিপক্ক্ব বা আনাড়ি জাতের নানান অযাচিত ধমক। কেউ একপেট খেতে দিতে চাইলে কত রাগ হজম করে সেটা খাওয়া লাগে তার। আসলে সে খুবই একটা মানবতর জীবন যাপন করে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এখানে কাজটা নিয়ে সে খুবই অপরাধ করে ফেলেছে। শুধু তাই নয় সামাজিকতার বিভিন্ন আদলে তাকে এমন ভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয় যা তার জন্য সেটা খুবই অসৌজন্যমূলক এবং অমানবিক। সে তো মানুষ । তারও কোন ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে। কোনো মানুষই তো ভুলের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু কোন কিছুতে সামান্য ভুল পেলেই যেন, মানুষ তাকে আঙ্গুল তুলে কথা বলে একেবারে তুলো ধুনা করে ছেড়ে দেয়। বলে কিনা, মোয়াজ্জেমের এটা করা ঠিক না; ওঠা করা ঠিক না। যেমন, তার বোর মাঠে ছাগল খাওয়ানো ঠিক না, চুলার লাকড়ি কুড়ানো ঠিক না, নদীতে গোসল করা ঠিক না ইত্যাদি ইত্যাদি। এরকম নানান জাতীয় লোকের ছবক কতবার যে তার হৃদয় ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয় তার কোনো অন্ত নেই। দারিদ্র্যের কষাঘাতে পর্যুদস্ত হয়ে সকল অপমান-অপদস্থ সহ্য করে তাকে এ কাজটা কোনো রকম চালিয়ে নিতেই হয়। অন্য কোনো সুযোগ থাকলে আমার মনে হয়; সে এক মুহুর্তের জন্যও এ কাজটা আর করতো না। যে মানুষটা এক সময় ছিল দুরন্ত-ডানপিটে এবং শৈশবে যে মানুষটা এতো দুরন্তপনার সাথে জীবন পরিচালনা করেছে; তার এখন জীবন সায়াহ্নে এসে জীবিকা অর্জনের সব পথ রুদ্ধ হয়ে আজ এই পেশাটাকেই সে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর যেটা তার হয়তো কখনোই লক্ষ্য ছিলনা যে, এই খানেই তার গতি হবে। তাহলে হয়তো অনেক দক্ষতাই উনি রপ্ত করে এপথে আসতেন। এমন কোনো পরিকল্পনাই হয়তো তার মাথায় ছিল না। কিন্তু নিয়তি তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আর সে সুযোগটা নিয়ে সমাজের মানুষ যে তাকে এভাবে অপদস্ত করবে হয়তো সেটাও তার কোনদিন জানা ছিল না।
Comments
Post a Comment