লাশের বাড়ি
লাশের বাড়ি
মো: এনামুল হক
চারিদিকে এত মৃত্যুর মিছিল যেখানে লাশের বাড়িতে স্বজনের আনাগোনা সত্যিই চোখে পড়ার মত। সম্প্রতি কয়েকটা লাশের বাড়ি গিয়ে মনটা আমার খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। একটা বিষয় গভীরভাবে লক্ষ্য করলাম, এলাকার কারো চিরবিদায়ে গ্রামের মাটির মানুষগুলো এখনও খুবই আবেগ প্রবণ। এছাড়া লাশের দাফন কার্য সম্পন্ন করা পর্যন্ত যতসব দায়িত্ব আছে তা সবাইমিলে আপন মনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যেভাবে নিজের ঘাড়ে তুলে নেওয়ার প্রবণতা প্রকাশ করে তা সত্যিই আমাকে যার পর নাই আপ্লুত করেছে। মৃতের এই অজুহাতে আবার ঐ সমাজে জিইয়ে থাকা কিছু ভুল বোঝাবুঝিরও অবসান হয় যা অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সেখানে শত্রু-মিত্রের ভেদাভেদটাও আর নেই।
সকলের আবেগী প্রচেষ্টায় স্থানীয় বাজারের দোকান থেকে কখন যে লাশের জন্য কাফনের কাপড় চলে এসেছে তা হয়ত মৃতের পরিবার জানেই না। গ্রাম্য লেভেলে ভাল আরবি পড়তে জানা পড়শি ভাই-বোনেরা রেহেলের উপর কোরান শরীফ রেখে লাশের পাশে বসে সূরা ইয়াছিনসহ কোরানের নানান গুরুত্বপূর্ণ আয়াত সুমধুর কণ্ঠে পাঠ করতে থাকে। আর অন্যদিকে আপন জনের হঠাত্ মৃত্যুতে একান্ত কাছের মানুষগুলো হৃদয়ের গহীনে ভেসে ওঠা স্মৃতি বিজড়িত নানান কথার করুন বিলাপে মূর্ছা যেতে থাকে। তখন পাশে থাকা মানুষগুলো তাকে সাপোর্ট দিয়ে কাছে বসিয়ে মাথায় তেল-পানি সহ নানা শান্তনামূলক কথা আউড়াতে থাকে। যেমন, সবারই তো একদিন চলে যেতে হবে- দুদিন আগে আর না হয় দুদিন পরে। ওগো! তুমি তো বাড়ির বড় সন্তান- তুমার এতো ভেঙ্গে পলি কি চলে,কও? তুমি ইট্টু শক্ত হয়ে উগার শান্তনা দাও। আবার মরা দেখতে আসা পাড়ার মা- চাচীরা মুর্দার আত্মীয় স্বজনের কান্নায় আপ্লুত হয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ রেখে মনের অজান্তেই কখন যেন আবেগী কান্নার ঢেউ তুলে দেয়।
মরহুমের আত্মীয় স্বজনের খবর দেবার জন্য এখনকার সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার হলেও আগেকার দিনে স্বজনদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খবর পৌঁছানো লাগতো। মৃত ব্যক্তির কাছের কেউ যদি জীবিকার তাগিদে দূরে অবস্থান করে, তবে তার আসার প্রহর গুনতে গুনতে অপেক্ষার আর শেষ থাকে না। ওদিকে আবার মসজিদের মাইকে আশপাশের লোকজনকে খবর দেবার জন্য মোয়াজ্জিনের করুন কণ্ঠে শোক সংবাদের জরুরি ঘোষনা ইথারে ভেষে আসতে থাকে।
কবর খোড়ায় পারদর্শী কিছু পরিচিত মুখ আপন দায়িত্বের খাতিরে খোন্তা কোদাল নিয়ে কবর খুঁড়তে লেগে যায়। কেউবা আবার ঝাড়ের বাঁশ কেটে লাশ দাফনের 'আতালে' আর কবর ঘেরার জন্য চটার বেড়া তৈরিতে মহাব্যস্ত সময় পার করে। ওদিকে আবার কেউ লাশ ধোয়ানো ও পরিবহনের জন্য মসজিদে রাখা খাটলা কাঁধে করে নিয়ে চলে আসে। বাড়ির এক সুবিধা মতো জায়গায় পর্দা টাঙিয়ে বরই বা নিম পাতা মিশ্রিত উষ্ণ গরম পানি দিয়ে দরদমাখা সিদ্ধ হস্তে অনেকেই লাশ ধোয়ানোর কাজটা সেরে ফেলতে উদ্যত হয়। এরপর খাটলায় শোয়ানো আর কাফন জড়ানো ছুরমা পরা লাশের পাশে লোবান কাঠির ধোয়া যেন মরা বাড়ির সেই চির পরিচিত গম্ভীর পরিবেশেরই ইঙ্গিত করে।
লাশের পাশে বসা মুরোব্বি গোছের লোকটি কাফনের মুখ খুলে মৃতের মুখটা আগত লোকদের দেখায় আবার ঢেকে রাখে। হাদিসের রেফারেন্স টেনে মাঝে মাঝে কেউ আবার মৃত ব্যক্তির বিশেষ করে নারী মৃতের মুখ কার দেখানো যাবে আর কার দেখানো যাবে না- এইটা নিয়ে একটা সাময়িক বাক বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। একারণে অনেকে আবার গুস্সা করে মরা না দেখেই বাড়ি চলে যেতে উদ্যত হয় এবং সেইসাথে মাঝে মধ্যে কিছু অপ্রীতিকর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয় যা পরে অভিজ্ঞদের হস্তক্ষেপে পরিবেশ স্বাভাবিক হয়। বেঁচে থাকতে যে নারী হয়তো কখনো পর্দার ধারে কাছেও যায়নি; কিন্তু আজ মরা লাশের পর্দার আদিখ্যেতা দেখে অনেকেই তাই বিরক্ত হয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে একটুও দ্বিধা করে না। মরা দেখে অনেকে বাড়ির উঠানে ছোট ছোট জটলায় মৃত ব্যক্তির নানা স্মৃতিচারণ করে আর আক্ষেপ করে তাদের ছোট্ট জীবনে বেঁচে থাকার নানা অর্থ খুঁজে হয়রান হয় আর নানা আফসোসের বিলাপ করতে থাকে। মূহুর্তের ব্যবধানে দূরের স্বজনেরা তীব্র বেদনামিশ্রিত চেহারায় ঝাঁকে ঝাঁকে মরা বাড়িতে আসতে থাকে আর পরস্পরের গলাগলি কান্নায় ক্ষণিকের ম্রিয়মান আস্ফালন আবারও যেন একটু তীক্ষ্ম রূপ ধারণ করে থমথমে পরিবেশটা আরো এক পশলা মেঘলা আকাশের মতো অনেক বেশি ভারি করে তোলে।
দূর থেকে আগত মেহমানদের উপস্থিত খাওয়ানোর জন্য গোষ্ঠীর মুরোব্বিদের নির্দেশনায় উত্সুক ছেলেপেলেরা পাড়ার সবার বাড়ি হতে চাল তুলে তুলে খিচুড়ি রান্না শুরু করে দেয়। জানাজা নামাজের সময় উপস্থিত জনতার সামনে দাঁড়িয়ে কাছের মানুষগুলো মৃতের পক্ষ হতে তার কৃতকর্মের জন্য মাফ চেয়ে নেয় এবং মৃত ব্যক্তি কারো কাছে কোন ঋণ থাকলে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়। অতঃপর আপনজনদের খাটলা বহনের সময় তিনবার ঘাড় পাল্টানোর রেওয়াজ মেনে মুখে কালেমা পড়তে পড়তে মুর্দাকে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কবরে নামা স্বজনদের হাতের স্পর্শে অতি যত্নে মায়েতের লাশটাকে কবরে রেখে উপস্থিত সবাই মুখে দোয়া দূরুদ পড়তে পড়তে তিন মুষ্টি করে মাটি কবরে প্রয়োগ করতে থাকে।
পাশ-খুন্দি অথবা সিন্দুক কবরের ভিতরে আতালে দিয়ে এরপর মাটিচাপা দিয়ে সুন্দর করে কবরের অবয়ব দেওয়া হয়। এরপর নির্মিত কবরের উপর শস্য বুনে পানি ছিটানোর কাজ শেষ করে অবশেষে একটা কাঁচা খেজুর পাতা মাঝ বরাবর চিরে কবরের উপর সুন্দর করে পুতে রেখে বাঁশের চরাট দিয়ে তা ঘিরে দেওয়া হয়। অতঃপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কবর ছেড়ে আসলে মৃত ব্যক্তির বিদেহী আত্মার জন্য আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে সকলের পক্ষ হতে হুজুরের দরদী কণ্ঠে দোয়ার আঞ্জাম শোনা যায়। এরপর অনেক জায়গায় গ্রাম্য সংস্কৃতির রেওয়াজ অনুযায়ী উপস্থিত জনতার মাঝে বাতসা ছিন্নি করতেও দেখা যায়।
মরা দেখে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পথে অনেককে আবার মুর্দার চারিত্রিক গুণাগুণ বর্ণনা করতেও দেখা যায়। যেমন লোকটা খুব ভালো ছিল রে। কালও দোকান থেকে সদায় নিয়ে গেল আর আজ দুনিয়ার সব সদায় চুকিয়ে চির বিদায় নিয়ে চলে গেল! খারাপ হলে বলে- বড়াই-অহংকার, ক্ষমতার জোর চিরদিন থাকে নারে ভাই; তাঁর কাছে একদিন ধরা দিতেই হবে। এরূপ নানা মন্তব্য করেও অবশেষে জানাজা, দাফন-কাফন শেষ করেই তবে বাড়ি ফেরে। তবে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করতে আবার পাশে থাকা অনেক ভারবুদ্ধি সম্পন্ন বুযুর্গ ব্যক্তিগণ নিষেধও করে থাকেন। রেওয়াজ মেনে মরা বাড়িতে তিন দিনের মত খাবার রান্নার উদ্দেশ্যে কোন হাড়ি জ্বালতে দেয় না, বরং প্রতিবেশীরা সবাই মিলে শোকার্ত পরিবারটিকে পালা করে খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন করে থাকে।
মরার পর মরা বাড়ির এতসব আনুষ্ঠানিকতা যত্নের সাথে শেষ করে আমরা সম্মিলিত ভাবে লাশের দাফন কার্য সম্পন্ন করি। কিন্তু লাশের আসল বাড়ির ঠিকানা সেই গহীন অন্ধকার কবরে চিরস্থায়ীভাবে থাকার জন্য যে আমলে সলেহার মত উত্তম সরঞ্জামের দরকার তা দুনিয়ার কোন মানুষের পক্ষেই যে আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব নয় তা মোটামুটি সকলেরই জানা। অথচ সেখানে বিদেহী আত্মার নেক আমল ব্যতীত মহাসাফল্য পাওয়াও তো প্রশ্নাতীত ভাবেই দুষ্কর। তাই সেক্ষেত্রে বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা কেবল অসার রূপেই প্রমাণিত হয়। আপনজনের কান্না, কাফন, আতর-সুরমা, রেখে যাওয়া আলিশান বাড়ি-গাড়ি, অভিজাত পোষাক, অঢেল সম্পদ, আদরের সন্তান-সন্ততি কিছুই তার সঙ্গী হবে না। তাই আসুন, মাটির উপরের আনুষ্ঠানিকতায় চোখ না ভিজিয়ে; আত্মার ভিতরের উত্কর্ষতায় চোখ ফিরাই।
Comments
Post a Comment