ঝিনুক ভাষায় গল্পকথা : অনেক দিনের স্বপ্ন
ঝিনুক ভাষায় গল্পকথা : অনেক দিনের স্বপ্ন
মোঃ এনামুল হক
চাকরি বা ব্যবসার সুবাদে অনেকেই বিদেশে বা নিজ এলাকার বাইরে থাকেন। সেক্ষেত্রে অন্যান্য জেলার মানুষ নির্দ্বিধায় তাদের স্ব স্ব আঞ্চলিক ভাষায় সুন্দর করে মনের ভাব প্রকাশ করে। কিন্তু আমাদের ঝিনাইদহের মানুষগুলো কেন জানি ঝিনাইদহের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পায়। আমি অনেক দিন ধরে এই বিষয়টি লক্ষ্য করি। আমার বুকটাও ঝিনাইদহের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার জন্য খাক হয়ে থাকতো। যখন আশেপাশে আমার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার মানুষ খুঁজে না পেতাম; তখন সোসাল মিডিয়ায় মনে মনে এমনই একটা প্লাটফর্ম খোঁজ করতাম যেটা আমার সংস্কৃতি বা আঞ্চলিক ভাষা চর্চার একটি দারুন উপলক্ষ হয়। মনে হতো প্রবাহিত নদীর মত আঞ্চলিক ভাষার শব্দগুলো যদি কলকল করে আজীবন আমার কানে বাজতো; তাহলে সেটা কতই না মধুর হতো। আমরা পেতাম মা-মাটির গন্ধ আর বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়ে থাকা প্রবাসী ভায়েরাও পেতো আপন মাতৃভূমির অকৃত্রিম নির্যাস। আর সেই প্রয়াস মিটানোর জন্যই হয়তো ঝিনাইদহের আঞ্চলিক ভাষা ভিত্তিক একটা গ্রুপের সন্ধান আমি পেয়ে যায় এবং সাথে পেয়ে যায় অসাধারণ ভালবাসার কিছু হৃদয় নিংড়ানো প্রিয় মুখ যাদের অকৃত্রিম উৎসাহ আর উদ্দীপনায় আমি আমার আঞ্চলিক ভাষায় এলাকার শিল্প-সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের নির্যাসকে স্বমহিমায় উপস্থাপন করার একটা সুযোগ পায়। এরপর গ্রুপে যখন এই লেখা গুলো এপ্রুভ হয়, তখন তা সাথে সাথে ব্যাপক সাড়া ফেলে ঝিনাইদহে বসবাসকারী মানুষসহ প্রবাসী সকল ভাই বোনদের হৃদয়ে সহজেই জায়গা করে নেয়। এরপর নাটকীয় আবহে আহবমান কাল থেকে মায়ের মুখ নিঃসৃত সেই হীরার মতো জ্বলজ্বলে আঞ্চলিক শব্দে গাঁথা কথামালায় গ্রথিত লেখাগুলোতে নির্দ্বিধায় প্রকাশ পেতে থাকে এলাকার ঐতিহ্যময় কৃষ্টি- কালচারসহ তৃণমূল বাংলার অজস্র গ্রামীণ আবহ। মানুষের জীবন বৈচিত্র্য, প্রাত্যহিক জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় এই ভাষার লেখায় অকৃত্রিমভাবে স্থান করে নেয়। ভাবি-ননদ আর নানা-নাতিদের প্রাণবন্ত খুনসুটি, স্বামী-স্ত্রীর মিষ্টি কড়া গ্রাম্য ঝগড়া, পাড়া প্রতিবেশিদের সুখ দুঃখের কথা এই লেখার মূল উপজীব্য বিষয় হয়ে ওঠে। যা পড়ে রোমাঞ্চিত হৃদয়ের গহীনে থাকা সুপ্ত অনুভূতি গুলো অবলীলায় জাগ্রত হতে থাকে। গ্রামের গাছিদের খেঁজুর গাছ কেটে রস বের করা, গরু দিয়ে ধান মাড়ানো, স্নিগ্ধ বাতাসে কুলায় ধান ওড়ানো, ভাত রান্না করা, গোরুর গাড়িতে ধান সংগ্রহ করা, নদীতে মাছ ধরা, চাষীদের নানান চাষাবাদ, রাখালের গরু-ছাগল মাঠে নিয়ে যাওয়ার প্রাকৃতিক দৃশ্যের আমেজ, শীতে পিঠাপুলি খাওয়া, চাদর গায়ে জড়িয়ে আগুন পোহানো ইত্যাদি বিভিন্ন গ্রামীন কাজেগুলোতে গ্রাম্য মানুষগুলো তাদের ব্যস্ত সময় পার করে।
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত প্রত্যেকটা স্বতন্ত্র ঋতু তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে গ্রামীণ এই মানুষের জীবনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে থাকে। তাই সেখানে তৈরি হয় আলাদা এক আবহ যেটা সত্যিই বটের নিবিড় ছায়ায় বিশ্রাম নেবার মতোই প্রশান্তি ছড়ায়। গ্রীষ্মের দাবদাহে কৃষকের তৃষিত বুকের কান্না মুছতেই যেন সেখানে রিমঝিম বর্ষার আগমন। শরতের কাশফুলের নরম ছোঁয়ায় মেতে ওঠা বাঙালি বঁধূর হাতে হেমন্তের নতুন ধানের বিচিত্র পিঠা তৈরি করে এক হেমন্ত মাখা পিঠা উৎসব। শীতের জবুথবু আর পর্যদুস্ত কৃষাণী বসন্তের কুহুতানে যেন কচি সবুজ পাতার মতোই গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতিটা পরতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। এরপর চারপাশের প্রাণোচ্ছল প্রকৃতি যেন নব বধূর সাজে সজ্জিত হয়ে এক অপরূপ সৌন্দর্যে পরিবেষ্টিত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ বাঙ্গালীর বাঙ্গালীয়ানা জীবনের সাথে ষড়ঋতুর একাত্মতার বৈশিষ্ট্যসহ প্রায় সমস্ত কিছুই আমার লেখার উপজীব্য হিসেবে টেনে তুলার চেষ্টা করেছি এবং ভেবেছি যে, এই কথাগুলো বা এই শব্দগুলো পৃথিবীর সকল বাংলা ভাষী মানুষের কাছে পৌঁছা দরকার। সাথে সাথে এ শব্দগুলো সংরক্ষিতও হওয়া দরকার বলে মনে হলো। কারণ আমাদের প্রজন্ম চলে গেলে পরে এই ভাষার শব্দ বা সাহিত্য হয়তো কেউ চর্চা করবে না। কিংবা কেউ ধরেও রাখবে না। অর্থ্যাৎ আগামী একশো বছর পরে আমাদের এই আঞ্চলিক ভাষার শব্দ, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি গুলো সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে যাবার উপক্রম হবে। আর একারনেই হয়তো সেটা ধরে রাখার প্রয়াসে আমিসহ ঝিনাইদহের অনেক গুণী ব্যক্তিই তাদের লেখার মাধ্যমে, কথার মাধ্যমে অথবা গানের মাধ্যমে এ ঐতিহ্যময় কৃষ্টি গুলো তুলে ধরার চেষ্টা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর সেই চেষ্টাগুলোর একটা ক্ষুদ্রপ্রয়াস হিসেবেই আমার এই আঞ্চলিক ভাষার বই প্রকাশের এই স্বতঃস্ফূর্ত দুঃসাহস আরকি। আবহমান বাংলার মানুষের মুখের সেই স্বর্ণোজ্জ্বল শব্দগুলোই এ লেখায় তুলে ধরবে আশা করি। এতে পরবর্তী প্রজন্ম জানবে আমাদের ভাষা কেমন ছিল। আর সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই আমি প্রত্যেকটা শব্দ অত্যন্ত যত্ন করে পাড়া গাঁ থেকে তুলে নিয়ে আমার লেখাতে স্থান দিয়েছি। যাতে ঐ ভাষা বা শব্দগুলো আমাদের প্রাণের ভাষা, আমাদের মুখের ভাষা, সর্বোপরি সবার অন্তরের ভাষা হতে পারে। তাছাড়া এই আঞ্চলিক ভাষা গুলো সারা বিশ্ব থেকে যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে বা বিলীন হয়ে যাচ্ছে সেটাকে রক্ষা করা বা তার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখারও এটা একটা সামান্য প্রয়াস হতে পারে। আমার এই হৃদয় নিংড়ানো সামান্য প্রচেষ্টার অব্যাহত ফসল আশা করি সবার ভালো লাগবে।
Comments
Post a Comment