পুণ্যভূমি সিলেটের মাজার

পুণ্যভূমি সিলেটের মাজার 

মোঃ এনামুল হক 


হুমায়ূন চত্বর থেকে সিএনজিতে ত্রিশ টাকা ভাড়ায় সোজা পৌঁছে গেলাম হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজার আম্বরখানায়। সেখানে মেইন রোড ছেড়ে পশ্চিম বরাবর রাস্তায় মিনিট খানেক হাঁটতেই সামনে দেখি বড় একটা গেট। ভাবসাব দেখে ঐটাই আমার কাছে সেই কাঙ্খিত মাজার বলে মনে হলো। তারপরও কনফার্ম হওয়ার জন্য স্থানীয় এক দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলাম, "ভাইজান, এটাই কি সেই হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজার?" উনি বললেন, "হ্যাঁ, প্রবেশ দরজা দিয়ে প্রবেশ করুন।" এরপর আমি ভিতরে ঢোকার পর একটু ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবেই ঘুরে বেড়াচ্ছি আর মনে মনে মূল মাজারটাকেই খোঁজ করছি। কিন্তু কাউকে বলছিনা। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একসময় মাজার প্রাঙ্গণের পূর্বপাশে গিয়ে দেখি অসংখ্য কবুতরের মুহুর্মুহু আনাগোনা। ওগুলো ঝপ ঝপ করে নিচে নেমে আসছে স্টিলের বেড়ায় নির্মিত এক উন্মুক্ত খাঁচার ভিতরে। পাশেই একটা দোতলা বিল্ডিং। সেই বিল্ডিংয়ের ছাদে এবং ভেন্টিলেটার বরাবর অগনিত কবুতরের আনাগোনা। যাইহোক, এখানকার মুগ্ধতা শেষ না হতেই আরেকটু সামনে চোখ গেল আমার। সেখানে দেখি আরেকটা জটলা। ঐ জটলার জট খুলতে সামনে এগোলে আমিও আটকে যাই সেই জটে। কেননা অল্প স্বাদে তো ওখানে মানুষ জট পাকায় নাই! ওদের মত আমিও তাকিয়ে দেখি, স্বচ্ছ নীলাভ পানির পুকুরে প্রায় দশ/বারো কেজি ওজনের শত শত গজার মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে। তাই সকলের বিস্মিত চোখ যেন সেখানে আঠার মতো লেগে গেছে। পাশেই একজন ঐ মাছের খাবার ছোট ছোট বাটিতে করে বিক্রি করছে। উত্সুক জনতা শখের বশে মাছগুলোকে খাওয়ানোর হাউশ মেটাতে বাটি ধরে তা কিনে নিয়ে আসছে । এরপর তারা খাবারের খণ্ডিত অংশ মাছগুলোর উদ্দেশ্যে ফেলছে এবং মাছগুলো তার ভয়ঙ্কর দেহের প্রচন্ড একটা সাঁট মেরে প্রতিযোগিতার সাথে সেই খাবারখুলো মুহূর্তের মধ্যেই সাবার করে দিচ্ছে। যাইহোক, এবার আমি মাজারের কথা মনে মনে না রেখে ওখানকার একজনের কাছে জিজ্ঞাসা করেই বসলাম। সে আমাকে পশ্চিম দিকের মসজিদের পাশের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যেতে বলল। সামনে এগিয়ে দেখি নিচে মহিলাদের ইবাদতের স্থান। তাদের আবার উপরে ওঠার অনুমতি নেই। পাশেই পাঁচ টাকা দিয়ে টোকেন নিয়ে জুতা একজনের কাছে নিরাপদে রেখে উপরে উঠতে হবে সকলকে। আমি কিছু না বুঝেই জুতা হাতে নিয়ে একটু উপরে উঠে দেখি নির্দেশনা লেখা আছে জুতা নিয়ে মাজারের ভিতর প্রবেশ করা যাবে না। তাই আমি অগত্যা ওখান থেকে মোড় নিয়ে পাশের মসজিদে ঢুকে পড়লাম। সেখানে মসজিদের জুতাদানিতে জুতা রেখে ঐ মসজিদে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে নিলাম। এরপর মসজিদের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে ওর ভিতরে একটু ঘুরে দেখলাম। এরপর আমি বাহিরে চলে এলাম।


জুতার জায়গায় জুতা থাকলো। আমি পশ্চিম অভিমুখে মাজারের গেট খুজঁছিলাম। তাই উঁকিঝুঁকি মারা দেখে এক মুরুব্বী গোছের চাচা ইশারা করে কাঙ্ক্ষিত দিকে ধাবিত হতে সাহায্য করল। মাজারে শান্ত পরিবেশে মনটা আমার ভরে গেল। মাজারের একেবারেই সম্মুখে চির নিদ্রায় শায়িত রয়েছেন ইতিহাসের সেই চিরন্তন কিংবদন্তী হযরত শাহজালাল (রঃ) যিনি শুধু ইয়েমেন থেকে 360 জন সফরসঙ্গীকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আসেন দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে। তরবারির জোরে নয়, শুধু আদর্শের জোরে তিনি সিলেটের পুরা হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় ইসলামের বীজ বপন করতে সক্ষম ছিলেন। সেই স্বপ্নের কিংবদন্তির মাজার বাস্তবে হাত দিয়ে ছুয়ে দেখতে পেরে অজানা খুশীর আমেজে মনটা আমার নেচে উঠল। উনার দক্ষিণ সিতেনে আরো চারজন এবং পশ্চিমে আরো একজন মোট পাঁচজন সফর সঙ্গীর মাজার সেখানে রয়েছে। সেখানে অসংখ্য ভক্ত বৃন্দ কবর জিয়ারত করতে ব্যস্ত সময় পার করছে। মোনাজাতে কেউ কেঁদে কেঁদে মনের আকুতি গুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করছে। কেউ আবার মাজারের শীতল মেজেতে লুটিয়ে পড়ে মনের আকুতি প্রকাশ করছে। কেউবা খাদিমের কাছে, আবার কেউবা মাজারের উপরেই টাকা উৎসর্গ করছে। মাজারের পশ্চিম এবং উত্তরে দেখতে পেলাম, এগারোটা তোরণ সম্মৃদ্ধ একটা বারান্দা রয়েছে। সেখানে কেউ নামাজের মাধ্যমে মনের বাসনা পূরণের আকুতি জানাচ্ছে। তাই আমিও দুই রাকাত নফল নামাজ পরে মনের আকুতি জানালাম আল্লাহর কাছে। এরপর ঘুরতে ঘুরতে পশ্চিমের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। সেখানে উঠে দেখি শুধু কবর কবর। আরেকটি সামনে যেতেই দেখি, নায়ক সালমান শাহের কবর। ওখানকার নির্দেশিকায়, ছবি তোলা সেখানে সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু আশেপাশে কেউ না থাকায় আমি মনের অজান্তেই সালমান শাহের কবর বরাবর একটা ছবি নিতে আর মিছ করলাম না। এবার মাজার থেকে নেমে ঘুরেফিরে দেখতে দেখতে টিলার পাশ ঘেঁষে ক্রমান্বয়ে পশ্চিমের দিকে এগোলাম। সামনে এগুতেই দেখি হযরত শাহজালাল (রঃ) এর পানি ব্যবহারের কূপ। সেখানে পাঁচ টাকায় জুতা রাখার টোকেন নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখি সেই পানি সমৃদ্ধ কূপটা অবস্থান করছে। ওখানে অনেকেই ছবি তুলছে দেখে আমিও একজনকে অনুরোধ করে একটা ছবি উঠিয়ে নিলাম। এরপর মাজারের পিছন ঘুরে কবরস্থানের ভিতরকার রাস্তা ধরে আমি মাজারের আঙিনায় আবার চলে এলাম। মসজিদের সামনের আঙিনায় অসংখ্য ভক্ত বৃন্দ চক্ষু মুদে জরাজীর্ণ দেহ নিয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। শেষ বিদায়ে মাজার কমপ্লেক্সটা আবার একনজর দেখতে দেখতে কয়েকটা ফটো নিলাম আমি। তারপর বাহির দরজা দিয়ে মাজার প্রাঙ্গণ ত্যাগ করলাম। বাইরে এসে কিছু চকলেট, মিষ্টি, আচার কিনে আমি শাহাপরান (রঃ) এর মাজার দেখার জন্য মেইন রোডের আরেকটা সিএনজিতে চড়ে বসলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আরও দু'জন সফরসঙ্গী যোগ হলে সিএনজিওয়ালা তার গাড়ি দিল টান। 50 টাকার গাড়ি ভাড়ায় আমাকে একটানে নিয়ে ফেললো হযরত শাহ পরানের (রঃ) এর মাজার প্রাঙ্গণে। সেখানেও প্রায় একই চিত্র। মহিলাদের এবাদত খানা নিচে এবং এখানেও তাদের মাজারে যাওয়ার অনুমতি নেই। মাজারের দান সদকা গ্রহণ করার জন্য দুইজন খাদেম বসে আছে। আমি একটু ঘুরে দেখার জন্য তখনই মূল মাজারে প্রবেশ করলাম না। ঘুরতে ঘুরতে সিএনজি স্টেশনের পাশ দিয়ে দেখি মসজিদে উঠার পথ। ওখানে সবাই দেখি জুতা পায় দিয়েই সিঁড়ি বেয়ে মসজিদে জোহরের নামাজ পড়তে যাচ্ছে। আমিও তাদের সাথে মাজারসংলগ্ন মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করে নিলাম। মূলত হযরত শাহ পরান(রঃ) এর মাজার হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজারের মতই একটা টিলার উপরে অবস্থিত। তাই সকলকে এই সিঁড়ি বেয়েই নামাজের জন্য ওই টিলার মসজিদে উঠতে হচ্ছিল। যাইহোক মসজিদের সামনে বিশাল বড় একটা ঈদগা মাঠ। ঐ মাঠ ঘুরেফিরে দেখতে দেখতে পাশেই আমার মত আরেকজন সফরকারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে আমার অনুরোধে সে আমারই কয়টা ফটো তুলে দিল।

Comments

Popular posts from this blog

খুঁজে ফিরি সেই গ্রাম