নৌকা ভ্রমণ
মো: এনামুল হক
তেইশে আগস্ট সোমবার। মৃদু রোদ মাখানো পড়ন্ত বিকেল বেলা। নিরীক্ষণ অতিথিদের বিদায় জানানো উপলক্ষে ম্যানেজার সারের আহ্বানে ঠিক হলো পাশের গড়াইয়ে আমরা একটু স্বস্তির খোঁজে নৌকা ভ্রমণে বের হবো। গন্তব্য কুষ্টিয়ার পদ্মা-গড়াই মোহনা। হরিপুর ব্রিজ হতে আমাদের যাত্রা শুরু হবে।

হরিপুর ছিল বিচ্ছিন্ন এক অবহেলিত জনপদ। এ জনপদ যেন বছরের পর বছর ধরে অভিমানের শক্ত শেকড় গেড়ে তার সান্নিধ্যে থাকা জেলে-মাঝি-হকারসহ ছোট বড় বিভিন্ন পেশার মানুষ নিয়ে নিজের মত করে বেঁচে আসছিল। উন্মত্ত পদ্মার উদ্বেলিত ঢেউয়ের বুক ছিড়ে আসা গড়াই নদী লালন-রবির চারণভূমি খ্যাত কুষ্টিয়ার উদার হৃদয় থেকে তার কলিজাটা যেন একপ্রকার ছিড়েই রেখেছিল। ফলে এই হরিপুর ব্রীজটি এখন সেই অনন্ত কালের বিরহের এক চিরস্থায়ী অবসান বলেই প্রতীয়মান হয়। ব্রীজের নীচে কংক্রিটে বাঁধানো গড়াই পাড়। আগে থেকেই তপুর ভাড়া করা একটা বড়সড় নৌকাও সেখানে অপেক্ষা করছিল। নৌকায় ওঠার সুবিধার্থে আয়েসী ভুঁড়ির স্থুলাকার এক মাঝি নদী পাড়ের সুবিধাজনক অবস্থানে তার নৌকাটা ভিড়ালো । আমরাও সবাই সাথে কিছু চিপস-চানাচুর নিয়ে সন্তর্পণে একে একে ঝুপঝাপ সেই নৌকার উপর উঠে পড়লাম। এরপর যার যার সুবিধামতো জায়গায় বসে প্রকৃতির অবারিত সৌন্দর্যের প্রলোভনে চোখ জুড়াতে লাগলাম।

নৌকা স্রোতের প্রতিকূলে চললেও আমাদের চক্ষু, হৃদয়, মন সবই যেন ছিল হংস মিথুনের উচ্ছ্বাসে ভরা গভীর জলাধারের মতোই আনন্দ স্রোতের অনুকূলে সদা ব্যস্ত।

শান বাঁধানো ঘাটে সারাদিনের পরিশ্রান্ত শ্রমিকের প্রশান্তির গোসল আর প্রস্ফুটিত সূর্যালোকে রাজহাঁসের স্বচ্ছ পানিতে ডুব খেলার সেই রাজকীয় খুনসুটি যেনো আনন্দে আত্মহারা শরীরের অনাবিল শ্রান্তি বিলাসে অবগাহন করার চাক্ষুষ ছবিই সকলের মানসপটে ভাস্বর হয়ে উঠলো। এদিকে আবার ইঞ্জিনের নৌকা কিছুদূর এগোতেই আমাদের সকলের দৃষ্টি গোচর হলো ঐ পাড়ের শুভ্র বালুর সুদীর্ঘ বাঁধ!

এ যেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতোই একটার পর একটা বালুর বস্তা ফেলে বালুর পাড়েরই ভাঙন রোধের এক অভিনব দৃশ্য। দূর লোকালয়ের সবুজ গাছগুলো তাই মাথা উঁচু করে নদী-কুলের সেই ভাঙা গড়া প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বৈরি বন্ধুত্বের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য উঁকি মেরে দেখছে। অকস্মাত্ দেখি আমাদের নৌকাটি এক পানি ঘেরা সবুজ রাজ্য অতিক্রম করছে।

তখন আমাদের কল্পবিলাসে ভেসে ওঠে গোধূলি মাখা একহাঁটু স্থির পানির বুকে দাঁড়িয়ে থাকা সেই চির সবুজের সমারোহ আর নবযৌবনা সাজে সজ্জিত এক বিস্তীর্ণ কাশবন। এ যেন টাকপড়া মাথায় সৌন্দর্য বিকাশে প্রাণান্ত প্রয়াসে মত্ত একখণ্ড সবুজ কাশবনের পরিকল্পিত জায়গা দখলের খুনসুটি। দূরের বালুচরে লাল বেনিতে রূপবতী ললনার রাঙা চরণের ঊর্মিসম ঝুমঝুম ঘূর্ণি নৃত্য যেন বিদ্যুত স্পৃষ্টের মত এক মুহূর্তের জন্য হৃদয় নাড়িয়ে গেলো।

বর্ণিল আকাশের ছামিয়ানার নিচে শুভ্র বালুর বিস্তীর্ণ আস্তরণকে বালিশ বানিয়ে নীলাভ স্বচ্ছ পানির খাটের উপর নিশ্চিত ফুরফুরে মেজাজে বিশ্রামের নিঃশ্বাস নিয়ে আয়েশের বাতাসে দোল খাচ্ছে মিস্টার কাশ বাবু। ফুলবিহিন চিরযৌবনা সবুজ কাশবন যেন নদীর ক্ষুরধার স্রোতধারা আর চিকচিকে শুভ্র বালুময় নদীপাড়কে নিবিঢ় মমতার প্রশান্ত মৈত্রীর অটুট বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে।

দিকবিদিক চঞ্চলতায় ব্যস্ত সদা উচ্ছ্বল চোখ দুটি ডানে ঘোরাতেই আবার দেখতে পেলাম দুইটা সহজ সরল প্রাকৃতিক মানুষ মাছ শিকারের অনাঢ়ম্বর আয়োজনে ভাবলেশহীন নির্মল আনন্দে সময় পার করছে। আর ওদের পেছনেই দেখতে পাই প্রাকৃতিক দৃশ্যের সৌন্দর্যটায় আরেকটু পরিপূর্ণতার জন্যই হয়তো দুজন সহাস্য নারী কলসি কাকে বহতা নদীর মতোই কাশবনের আঁকাবাঁকা পথের জঞ্জাল মাড়িয়ে অবশেষে গড়াইয়ে গড়িয়ে পড়ার প্রয়াসে সদা ব্যাকুলতায় চঞ্চল হয়ে উঠেছে।

ভরা নদীর বুক চিরে নৌকা আরেকটু এগোতেই দেকি চারিপাশ থৈথৈ পানিঘেরা ছোট্ট একফালি বাঁধের উপর সৃষ্টি কর্তার পরম কৃতজ্ঞায় নিমগ্ন হয়ে নরম জমিনে সেজদা রাখছে মুরোব্বি গোছের এক চাচা।

নৌকা তার নিজস্ব গতিতে চললেও আমরা সবাই যার যার মত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রহস্যময় হাতছানিতে নিমগ্ন হয়ে আছি। তাই অবচেতন মনের এক ফাঁকে দেখতে পেলাম, দূরের পাড়ে নদীর প্রতিবেশীদের জীবিকার উত্স বালু তোলা নৌকা নদীর বুক ড্রেজিং করে রানীক্ষেতে আক্রান্ত মুরগির মতই খাবি খেতে খেতে সারাদিন সমানে বালু উত্তোলনের কাজে মহাব্যস্ত সময় পার করছে।

এরপর অনুসন্ধানী মনের খোরাক জোগাতে এপারের দৃশ্য অবলোকনের পর ওপারের দৃশ্যপটে চোখ বোলানোর পালা। তাই ভুঁড়েল মাঝি মাঝ নদীতে নৌকা ঘুরোতেই চোখে পড়লো উন্মত্ত গড়াইয়ের বুক ফুঁড়ে ওঠা বৃত্তাকার ধরণের ভয়ঙ্কর পাঁক খাওয়া পানি। এরপর ওপারে গিয়েই আবার চোখ আটকে গেল এক ঐতিহ্যময় বালুর ঘাটের দিকে। কুষ্টিয়ার নামকরা সেই তালবাড়িয়া বালুরঘাটের চিকচিকে চোখ ধাঁধানো বালুর আস্তরণ আর পশ্চিমে অস্তপ্রায় সূর্যের প্রতিফলিত রক্তিম আভা মিলে একাকার হয়ে সূচনা করেছে অন্যরকম সৌন্দর্যের এক রহস্যময় লীলাভুমি। জীবন ও জীবিকার তাগিদে বালু শ্রমিক গুলো বেলচা দিয়ে অতি যত্নে তৈরি করে রেখেছে সারি সারি গম্বুজাকৃতির অসংখ্য বালু-স্তুপ।
অতঃপর পদ্মা গড়াই মোহনাতে পৌঁছাতেই শীতল চোখের মায়াবি পর্দায় প্রতিফলিত হতে লাগলো পেঁজা তুলোর মতো শুভ্র আর সোনালী গম্বুজ আকৃতির মেঘের পাহাড়ের আস্তরণে চিত্রিত স্নিগ্ধ নীল আকাশ। সেই সন্ধ্যার গোধূলি মাখানো স্বর্ণালি আকাশ যেন থরে থরে সাজানো স্বর্ণ খচিত সীমাহীন বিস্তৃত বিছানা ।

সোনালী সূর্যের কোমল মৃদু রশ্মিচ্ছটায় যেন ঝরে পড়ছে স্বর্ণ বৃষ্টি। সেই মরিচিকাময় ঝিরিঝিরি স্বর্ণ বৃষ্টি স্নাত নদীবক্ষ যেন ঢেউয়ের কল্লোলে বিরহ-ফেরত আবেগী প্রেয়সীর মত ছলছল গল্পে মেতে উঠেছে। তাইনা দেখে কতযে কল্পকথার ভেলায় চড়ে প্রানোচ্ছ্বল দর্শনার্থীর মনের কোণে অনবরত হাজারো বৈচিত্র্যময় প্রশান্তির ঢেউ খেলে যাচ্ছে তা কে জানে।

এ যেন স্বচ্ছ পানির উঠানে ছড়িয়ে পড়া স্বর্গালয়ের জানালা খুলে অনিন্দ্য সৌন্দর্যে বিপর্যস্ত এক অপ্সরীর অধরে মেখে থাকা একমুঠো রোদ্রের সোনা ঝরা উচ্ছ্বল টলটলে মিষ্টি হাসি যা নিভৃতে সবার স্বতঃস্ফূর্ত মনের অতলস্পর্শে অনবরত খুন ঝরিয়ে যাচ্চে।

শত ব্যস্ততার মাঝেও অদম্য মানসিকতায় অনুপ্রাণিত ঐ মুরোব্বি চাচার অনুপ্রেরণা পেয়ে আমরাও আছরের নামাজ আদায় করলাম নৌকার সংকীর্ণ পাঠাতনে দাঁড়িয়েই। তাঁর বড়ত্বের কাছে মাথা নোয়ানো ঐ শ্রেষ্ঠ সময়টা যেন প্রকৃতির নির্মল অভ্যর্থনায় একাকার হয়ে গেলো। ঐ সুবিশাল আকাশ, তেজোদীপ্ত সূর্য, বিস্তীর্ণ পৃথিবীর একফালি মোহনা সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমার সব আয়োজনই যেন সেখানে সমহিমায় হাজির। তাই মাঝে মধ্যে এমন ভ্রমণে শামিল হয়ে এরূপ প্রকৃতির অপার লীলাভুমির মাঝে ডুব না দিলে হয়ত সৃষ্টিকর্তার সেই নিগূঢ় রহস্যময়তার নিখুঁত রূপ চেনার ক্ষেত্রে অনেক কিছুই বাকি থেকে যেতো।

রিযিকের সন্ধানে পদ্মার ওপারে পাড়ি জমানো কিছু নাম নাজানা উড়ন্ত পাখি উদারপূর্তি করে নীড়ে ফিরছে তুষ্ট কলরবে। ছোট্ট সাইজের কালো একটা পাখি নৌকার পাশ দিয়ে নদীর পানির সাথে প্রায় দুই ইন্চি দূরত্ব বজায় রেখে শা শা করে কোথায় যে উড়ে গেল তার কোনো হদিস মিলল না। যাইহোক, অবারিত সৌন্দর্যের মোহে মন ছোটাছুটি করলেও এবার পাখির মতো সন্তুষ্ট চিত্তে আমাদেরও নীড়ে ফেরার পালা। তাই ভুঁড়েল মাঝি আবারও তার তরী ভাসালো অচেনা সৌন্দর্যে ভরপুর সেই হরিপুর চর ঘেঁষে আমাদের গন্তব্য অভিমুখে।

ফলে দেখতে পেলাম আমাদের কাঙ্খিত সেই পদ্মা গড়াই মোহনায় সৃষ্ট হরিপুর চর যেখানে প্রাণের মেলায় সৃষ্টি হয়েছে এক উত্ফুল্ল প্রাণের সতেজ প্রকাশ। এ যেনো পানি, মাটি এবং বৃক্ষের সমাহারে তৈরিকৃত প্রকৃতির নিজ হাতে সাজানো এক গোলাকার সিঁড়ির তিনটি স্তর। ফলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, হয়তো সেই সিঁড়ির পরতে বসে নববিবাহিত কোনো এক আনমুনা গৃহবধূ যেনো অবচেতন মনে পদ সিঞ্চন করছে তার চির কাঙ্ক্ষিত প্রিয়তমের অলীক ইশারায়। আর সেই সিঁড়ির উপরের স্তরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা চিরহরিত্ বৃক্ষের সবুজ সতেজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন স্বচ্ছ পানির বাঁকা স্রোতে নিজের প্রতিচ্ছবিরই সাঁতার শেখাচ্ছে।

ভুঁড়েল মাঝি তার শরীরের মতই দায়িত্বে অটল থেকে ক্ষুরধার স্রোতের মাঝেও দক্ষ হাতে নৌকা পরিচালনা করে যাচ্ছেন।

সেই সাথে মনের আনন্দ যে অবারিত প্রকৃতির উচ্ছ্বাসে সাড়া দেয় তা আমাদের ম্যানেজার সার মো: এনায়েত ফকির সহ সাথে থাকা গেস্টদের মুখের অভিব্যক্তি দেখেই তা বোঝা গেলো। মনের কোণে আঁকা সেই অসামান্য মূহুর্তের কিছু রোমাঞ্চকর ছবি হৃদয়ের হার্ডডিস্ক থেকে চর্ম চোক্ষে স্মৃতিময় করে রাখার জন্য হাতে থাকা সেলফোনের কয়েকটি ক্লিকেই তার কিছু ছবি ফটাফট আমার ক্যামেরায় বন্দী করে নিলাম।

সারাদিন কর্মব্যস্ততার কর্কশ সময় পার করে বিস্তীর্ণ পানির একখণ্ড নৌকার উপর পড়ন্ত বিকেলের মৃদু মিষ্টি রোদ আর ফুরফুরে স্নিগ্ধ ঝিরিঝিরি বাতাস যে কত প্রশান্তিময় হতে পারে তা স্বশরীরে অনুপস্থিত কাউকে বোঝাতে এর চাইতে আর কোনো প্রকৃষ্ট উদাহরণের জুড়ি মেলা ভার !
Comments
Post a Comment