মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতে

মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতে

মোঃ এনামুল হক 


বড়লেখা হচ্ছে মৌলভীবাজারের একটা উপজেলা। সেখান থেকে সিএনজি যোগে আমি কাঠালতলী গেলাম। উদ্দেশ্য মাধবকুণ্ডে জলপ্রপাতের দৃশ্যে চোখ জুড়াবো। তাই কাঠালতলী থেকে একটা সিএনজি রিজার্ভ করে মাধবকুণ্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। তবে জলপ্রপাতের দৃশ্যে বিমোহিত হবার পূর্বেই পথিমধ্যে টিলার দুইপাশের সৌন্দর্যের অপার ফল্গুধারা যেন আপন মমতায় খেলা করে বেড়াচ্ছে। সেইসাথে টিলার পাদদেশে সমতল ভূমির ঐ বৈচিত্র্যময় রূপের দীপ্তিময় সৌন্দর্যই বা কম কিসে যায়? সেখানে ভরাট সবুজের দারাজ সমারোহ যেন আমার চোখের জ্যোতিকে দ্বিগুন উজ্জ্বল করে চলেছে। খানিক দূরের ঐ লাল গাভীটা নিবিড় সবুজ ঘাসের আস্তরণে তার তেল চুয়ানো দেহের প্রায় অর্ধেকটাই ডুবিয়ে দিয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে এমনভাবে ঘাস চর্বণ করছে যা দেখে মনে হচ্ছে বাইরের জগতের কে বা কারা তার সৌন্দর্যের মোহে পড়ে আনন্দে লুটোপুটি খাচ্ছে সেদিকে তার যে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অবশেষে পৌছে গেলাম সেই কাঙ্খিত মাধবকুণ্ড ইকো পার্কের গেটে। বিশ টাকার টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকতেই নানা সৌন্দর্যের হাতছানি। এরপর এপাশ ওপাশ তাকাতে তাকাতে চলে গেলাম ঠিক জলপ্রপাতের কাছে। সেখানে সুউচ্চ পাহাড়ের উপর থেকে অবারিত ধারায় পানির ফোয়ারা ঝরতে দেখে মনটা আরেকবার সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতার ভারে অবনত হয়ে আসলো। নিচে যেখানটাতে মূলত জল প্রপাত হচ্ছে সেখানটাতে প্রবাহমান স্বচ্ছ ধারার মিষ্টি পানিতে আমার বিশ্বয়াভিভূত চোখটা আটকে গেল। সেখানে দেখতে পেলাম, ছোট্ট ছোট্ট মাছ আর ব্যাঙের বাচ্চারা স্বচ্ছ পানির দোলায় ইচ্ছেমত খেলা করে বেড়াচ্ছে। আর এই দৃশ্য গোলো অনবরত আমার চক্ষু ক্যামেরার তীক্ষ্ণ রেজুলেশনে দারুণভাবে ধরা পড়ছে। কুলকুল স্রোত-ধ্বনির অদৃশ্য স্পন্দন হৃদয়ের আনন্দ মহলে রীতিমতো অবারিত উচ্ছ্বাস তরঙ্গের খঞ্জনি বাজাচ্ছে তা আমি ইতিমধ্যেই টের পেতে শুরু করেছি। তাই এতক্ষণ ধরে আনন্দগুলো আমার নিজের ভিতরই সাপলুডো খেলে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বাইরে আসার পথ কোনোরকম খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ দেখি জলপ্রপাত অভিমুখে তিনটা ছেলে আসলো। এতক্ষণ হৃদয়ের আনন্দগুলো আমি নিজে নিজেই শেয়ার করছিলাম। এরপর ওরা তিনজন এলেই আমি ভিডিও অন করে তাদের হাতে আমার ক্যামেরাটা দিয়ে দিলাম। আর ক্যামেরার সামনে আমি নিজের সাথে নিজেই জলকেলিতে মেতে উঠি। 


আমার উচ্ছ্বাসের মুহূর্তগুলো ছেলেটি খুব দক্ষ হাতেই ধারণ করেছিল। উচ্ছ্বাসের একপর্যায়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "তুমি পড়ালেখা করো না?" সে বললো, "না ভাইয়া, এখন আর করিনা, ছেড়ে দিয়েছি। আমি এখন বাবার সাথে কাজ করি।" যাইহোক, ঐ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আমি আবার পরক্ষণেই স্বানন্দেই বলে উঠলাম," আচ্ছা ছোট ভাই, ঐযে যেখান থেকে পানি বের হচ্ছে ওইখানটাতে ওঠা যায় না?" ওরা তিনজনই সমস্বরে উত্তর দিল,"যায় ভাইয়া। ঐপাশ দিয়ে রাস্তা আছে। বিশ মিনিটের পথ। আমরা আপনাকে ওখানে নিয়ে যেতে পারবো।" তবে রোজা থেকে ক্লান্ত হয়ে বিকালবেলা এত দূর আর হাঁটার রিস্ক নিলাম না। অবশেষে ক্লান্ত শরীরের সাথে প্রফুল্লে ভরা সঞ্জীবিত মনকে নিয়ে ইকো পার্কের গেটের দিকে রওনা দিলাম। পাহাড়ের গায়ে ঘন বনভূমিতে বাদরের বাদরামি আর বিচিত্র পাখ-পাখালির কুহুতানে কখন যে আমার সময়ের বিদায় ঘন্টা গড়িয়ে গেছে তা আমি টেরই পাইনি। যাইহোক, সবকিছু মোটামুটি দেখেশুনে এসে এবার উপলব্ধির ঢেকুর তুলতে তুলতে আমি মাধবকুণ্ড ইকো পার্কের একদম গেটের বাইরে বেরিয়ে এলাম। 


বাইরে এসে কিছু দূর হাঁটতেই দেখি, লাল, কালো বা সাদা রংয়ের ছোট বড় বিচিত্র গরুগুলো দুরন্ত মাঠের পতিত জমির বুকে বিন্যাসিত কার্পেটে শিল্পীর নিপুণ হাতে আঁকা ছবির মতোই আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। গরু দেখাশোনার পাশাপাশি চাচা বয়সী একটা লোক দেখি পাহাড়ি পালংশাকসহ অন্যান্য নানা জাতের মিশ্র শাক রাস্তার ধারে বসেই বিক্রি করছে। ঐদিক থেকে আসা কিছু লুঙ্গি পরা লোক মোটরসাইকেল থেকে নেমেই যেন শাক কেনার জন্য দামাদামি করছে। টিলার গায়ে চা বাগানের সৌন্দর্যের প্রেমে আপ্লুত হয়ে আমি ক্যামেরা হাতে ছুটছি তো ছুটছিই।


টিলার পাশের এক আঁকাবাঁকা পথ ধরে এক শিশু সবেগে সাইকেল চালিয়ে একেবারে মেইন রাস্তায় চলে এল। আমার ছবি তোলা দেখে সে খুবই লজ্জা পেয়ে গেল। শিশুটির বড় ভাইও ওখানে দাঁড়ানো ছিল। সে বলল, "ভাইয়া, ছবি তুলেন না। লজ্জা পায়।" আমি ক্যামেরা তার দিক থেকে সরিয়ে বড় ভাইয়ের হাতে দিয়ে বললাম, "ছোট ভাইয়া, আমার কটা ছবি তুলে দেবে তুমি? ও ইতিবাচক ঘাড় নাড়ালে আমার মোবাইলটা ওর হাতে দিই এবং সুন্দর করে কিছু ছবি তুলে দিতে বলি। আমি মূলত মাধবকুণ্ড ইকোপার্কের বাইরে এসে ফিরে যাওয়ার জন্য যানবাহন না পেয়ে ততক্ষণ ইতঃস্তত বিক্ষিপ্তভাবে এই সৌন্দর্যের স্বর্গরাজ্যে বেমালুম ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে কখন যে বিকালের সোনালী রৌদ্র দুপুরের তপ্তদাহ থেকে তেজ কুমিয়ে নরম স্নিগ্ধ ম্রিয়মান ধারায় সবুজ পত্র-পল্লবে উজ্জ্বল ধারার দ্যুতি ছড়াচ্ছে তা খেয়ালই করিনি আমি। হতচকিত হয়ে তাই চটজলদি ঘড়ির দিকে তাকিয়েই যাত্রী বোঝাই এক রিক্সাওয়ালাকে বললাম, "ভাই, ফিরতি পথে আমায় নিয়ে যায়েন তো। ঘাড় নাড়িয়ে ইতিবাচক  সম্মতির পর, ঐ রিকশাওয়ালা ঠিকই যাত্রীগুলো ইকোপার্কে রেখেই আবার আমাকে আমার গন্তব্যে ফেরত নিতে চলে এসেছে।

Comments

Popular posts from this blog

খুঁজে ফিরি সেই গ্রাম