খুঁজে ফিরি সেই গ্রাম
খুঁজে ফিরি সেই গ্রাম
মো: এনামুল হক
প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক নদীর ধারের গ্রামে ছিলো আমার বেড়ে ওঠা। গ্রাম্য মাটির গন্ধ প্রায় সর্বত্র ম ম করতো। বৃষ্টির সময় শহর বাজারে আসতে হলে কাদার ভয়ঙ্কর চিত্র এখনো চোখে ভাসে। শহরের মতো বিদ্যুতের ঝলকানি তখনো গ্রামে স্বপ্নের অপ্সরা বলেই মনে হতো। এটা সম্ভবত সেই সাতানব্বই আটানব্বইয়ের কথা। সারা গ্রামে টিভি ছিলো মোটের উপর দুটো কি একটা। আধুনিকতার হালচাল তখন ছিটেফোঁটাও লাগেনি ঐ অজ পাড়া গায়। সভ্য আধুনিক কালের ঝলকানি না থাকলেও আমাদের ছোট্ট গ্রামটি ছিলো বটগাছের ছায়ার মতো অনাবিল শান্তির এক মূর্ত প্রতীক। এখনকোর মত গ্রাম্য রাজনীতির নোংরা চর্চা তখন ছিলো না বল্লেই চলে। চারিদিক ঐতিহ্য আর কুটির শিল্পের নানা শাখায় ছিলো যথেষ্ট টইটম্বুর। বর্ষায় নদী যখন ভরপুর হয়ে যেত তখন বদো মামু খ্যাপলা জালে মাছ শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। আবার রাতের অন্ধকারে মিশো, ফজা, মুকা, মস্তাসহ গ্রামের অনেকেরই আলো কাটায় মাছ ধরা ছিলো নেশার মতো অভ্যাস। ঐদিকে মইরে, বিশে, বান্টাসহ অনেকেই দল বেঁধে জুত হাতে করে নদীর পাড় বেয়ে বেয়ে নিজের গ্রাম ছেড়ে দূরের গাঁয়ের ভিতর পর্যন্ত ঢুকে শৈল, গজাড় মাছ শিকার করে বেড়াতো। কুষ্টার জাগে পানি গন্ধ হয়ে 'গাবা' লাগলে সর্ব সাধারণ ঠ্যালা জাল, থরকোচ, পলো ইত্যাদির সাহায্যে জিয়েল, পাকাল, চিংড়ি, ট্যাংরা,পুঁটি, গরগতে ইত্যাদি মাছ শিকার করতে মহাব্যস্ত হয়ে পড়তো। ওদিকে আবার তুপা নানা বিলের ধারে হেড়ে পেতে , আবার কখনো রাবানি বা শোলার বরশায় টোপ গেঁথে চ্যাং, ব্যাম ফলইসহ নানা জাতের মাছ শিকার করে আনতো বাড়িতে। এক কথায় পাড়া মহল্লায় তখন মাছ ধরার এক মহা ধুম পড়ে যেতো। পাশের বাড়ির কবিরাজ নানা আসন দিয়ে জিন হাজির করত আর দূর দূরান্তের অসংখ্য মানুষ জিনের মাধ্যমে তাদের বিচিত্র সমস্যার সমাধানের জন্য বাড়ির উঠানে জটলা পাকাতো। নিকেরি পাড়ার 'আলা ভাই' ছিলো জিন হাজির আসরের প্রধান সদস্য। নুরি মস্তান নামক জীন মাঝে মাঝে জিকিরের মধ্যে হঠাত্ কবিরাজ নানার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে আলার পিঠে ঢপঢপ করে কিল বসিয়ে দিতো। জিন চিকিত্সায় আলার ঘরে ফুটফুটে সন্তান আসার দৃঢ় বিশ্বাসে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সে কবিরাজ নানার কোনো একটা 'জীন হাজির আসর' কখনই মিস্ করতো না। মাঝে মাঝে পাগল বা মাথার ছিট খারাপ রোগীরা কবিরাজ বাড়ি ভিড় করতো। কবিরাজ নানা নতুন গামছা বা শাড়ির ছাদগার বিনিময়ে জলসর করে দিলে মানসিক রোগের নিরাময় হতো বলে সুদূর অঞ্চল পর্যন্ত সুনাম ছড়িয়ে ছিলো। জিন ছাড়াতে পাটের আশ দিয়ে রোগীর কনিষ্ঠ আঙুল এঁটে কষে বেঁধে তার নাম ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতো নানা। কবিরাজ নানার খোলাটে বার্ষিক ওরস মাহফিল আমাদের আনন্দময় প্রানের মেলার আমেজে রূপ নিতো। গ্রামের পরিচিত ভাই ভাগাররা বড়া, পেঁয়াজু, চপ, বেগুনি ইত্যাদির টং দোকান বসিয়ে তা দেদারছে বেচা বিক্রি করতো। মাঝেমধ্যে মনে হতো মাহফিলের চাইতে মেলায়ই যেন লোকজনের সমাবেশ বেশি। মনুর বাড়ির উঠানে খঞ্জনি, দোতারা বাজিয়ে আধ্যাত্মিক ভাব-গাম্ভীর্যের গায়ো সুরের বিচিত্র গান অনেক রাত পর্যন্ত চলতো। মাঝে মাঝে সন্ধার নিয়ম মাফিক পড়ার পাঠ না চুকিয়েই বাজনার তালে মন নাচিয়ে চলে যেতাম গানের আসরে যোগ দিতে। বউছি, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবাধা, পলাপলি, জলকেলি ইত্যাদি খেলায় সারা বিকাল থাকতো রঙিন। নদীর ঐপারে যদি কখনো কালেভেদ্র ট্রাক্টরে জমি চাষ করতে আসতো তাহলে আমরা সব উত্সুক ছেলেপেলেরা নদীর এপাড়ে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত জিনিস ভেবে তা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতাম। সর্দার পাড়া বা মদ্দি পাড়ায় মাঝে মধ্যে লাঠি খেলার দল আসতো। সেই লাঠি খেলার প্লেয়ারের নানান কসরত্ দেখে মন প্রাণ একেবারে জুড়িয়ে যেতো। ছিলেখানার দরগায় কলার পাতা বিছিয়ে ছিন্নি খাওয়ার মজা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। পায়ে চালানো ভ্যান নৌকার মতো ছাউনি দিয়ে রহমান ভা'র সুয়ারি ভাড়া মারার দৃশ্যপট এখনো চোখে ভাসে। নায়ের করা নতুন বো'র বস্তায় আনা খৈ, মুড়কি আর বাতসার স্বাদ আজও মুখে জড়িয়ে আছে। সন্তানের মুখে ভাত, বিয়ে, সুন্নাতে খাতনা, হালখাতা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে সবাই লম্বা বাঁশের মাথায় মাইক লাগিয়ে উচ্চ শব্দে গান বাজাতো। বিনোদনের প্রিয় উত্স হিসেবে নসিমন-আলমসাধু যাত্রা দেখার জন্য তক্কেল, মতেসহ অনেকেই দল বেঁধে দিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে সন্ধ্যায় গামছা আর পাঁচ ব্যাটারির টর্চ লাইট হাতে করে পাশের গ্রামে হনহন করে হেঁটে চলতো। পালা করে সুলতান- আজিত ভাই, জুব্বার মনিরুল মামারা গ্রামে ভিসিআর আনতো। তখন এই ভিসিআর দেখা এত আকর্ষণীয় ছিল যে অভিভাবকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা কয় বন্ধু যুক্তি করে মোরগডাকা ভোর পর্যন্ত সিনেমা দেখে ঘুম মাখা লাল চোখ ডলতে ডলতে পা না ধুয়েই চুপিসারে এসে শুয়ে পড়তাম। অনেক সময় আবার মায়ের চোখে ধরাও খেয়ে যেতাম। ঐপাড়ায় বক্করের বাড়ি টিভিতে সিনেমা দেখতে যাবে বলে সুরোত, ফ্যারো, আজো, শুক্রবারের দিন সকাল টানে ঘাটে গোছোল সেরে নিতো। নানা কারণে দীর্ঘদিন গ্রামের বাইরে থাকায় আর সেইসাথে অধিক বয়স্ক মানুষগুলোর পাকা চুল-দাঁড়ির ফাঁকে চেহারা ডুবে থাকায় অনেক পরিচিত কাছের মানুষকেও এখন চিনতে কেমন জানি কষ্ট হয়ে যায়। পরিচিতদের মধ্যে অনেকে আবার পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরদিনের মত চলেও গেছেন। খবরও পাইনি। তাই তো ভাঙা গলায় আজান দেওয়া সেই মোয়াজ্জিনের কণ্ঠটাও আজ আর শুনতে পাইনা। আনাগোনা না দেখে হঠাত্ জিজ্ঞাসা করলে শুনি- সেতো কবে মারা গেছে! এরপর সভ্যতা নামের ভুত আস্তে আস্তে গ্রাস করে ফেলেছে সারা গ্রাম। আমার বাড়ির পাশ ঘেঁষে এক হাঁটু কর্দমাক্ত রাস্তাটা আজ পাকা হয়েছে। বিদ্যুতের লাইনের সাথে ডিশ লাইনের তারও হিজবিজি হয়ে আছে সারা গ্রাম। ওয়াইফাই লাইনের চারপাশে উঠতি যুবকদের এন্ড্রয়েড সেটে পাবজি, ফ্রি ফায়ারও চলছে সমান গতিতে। কিন্তু নদী পাড়ের আমতলার সেই জৌলুসপূর্ণ গল্প আসর কি আর আছে? আহ ! ময়নার মা'র পা মেলে দিয়ে কাঁথায় ধাগা দেওয়ার তালে তালে পান খাওয়া ঠোঁটে সেই মিষ্টি হাসির রেশ যেন আজও চোখে ভাসে। চড়ুইভাতিগুলো যেন এখন পরিণত হয়েছে ডিজে গানের অদ্ভুত আসরে। ভরা নদীর বাঁকে বসে জোসনা রাতের মজনুর সেই প্রাণমাতানো বাঁশির সুর আর কানে ভেসে আসে না। মনু মামা ওপারে চলে যাওয়াই তার ভক্তবৃন্দ উঠানের মাঝে জটলা পাকিয়ে সেই আধ্যাত্মিক গানের আসর আর বসায় না। টেকনোলজিময় গ্লোবাল ভিলেজটা আজ আসল ভিলেজকে সরিয়ে দিচ্ছে প্রকৃত সামাজিকতার দরদমাখা ঐতিহ্যকে। কাছে বসে দুটি সুখ-দুঃখের কথা বলার মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া ভার। হিংসা, রেষারেষি আর হানাহানিতে সমাজ হয়ে উঠেছে উত্তপ্ত। ভাটা পড়েছে সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধন। তবে এখনো ইচ্ছা জাগে মাটির গন্ধে ভরপুর সেই ছোট্ট গ্রামের স্নিগ্ধ পরিবেশে আবার ফিরে যাব। কিন্তু যখন ভাবি দরদমাখা ঐতিহ্য আর শিল্প- সংস্কৃতির আবহমান ধারার গায়ে আর অবগাহন করতে পারব না তখন সুপ্ত হৃদয়টা আবার ভিতর থেকে মোচড় দিয়ে ওঠে। সেই কবিরাজ নানার জিন হাজিরের আসর, কুমড়া বড়ি কোটা ঢেকির ঢপঢপ শব্দ, নিঝুম রাতে হুতুম পেঁচার গম্ভীর ডাক, পড়ন্ত বিকেলের ঝুপড়ি আমগাছে চড়ুই, শালিক আর বুলবুলির কলকাকলি সবই যেন স্বপ্নচোখে ভাস্বর হয়ে ওঠে।
খুব সুন্দর। 💛💛💛🧡
ReplyDelete