জামতলার ভূত

জামতলার ভূত 

মোঃ এনামুল হক 

দূরন্ত মাঠের মধ্যমণি স্বরূপ নিবিড় পত্র-পল্লবে সজ্জিত ছোট্ট একটা জাম গাছ। যেটা ঐ থৈ থৈ ধান ক্ষেতের নিবিঢ় সমুদ্রে খাঁখাঁ তপ্ত দুপুরের তীব্র রোদের মরুময়তায় ছায়াময় প্রতিনিধিত্বকের মূর্ত প্রতীক হিসেবে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। মৃদু স্নিগ্ধ বায়ুর লাজুক স্পর্শে চারিদিকটা যেন অবারিত সবুজ সোনালি ধানের প্রাণ মাতানো ঢেউয়ের নিরব আস্ফালনে মাতোয়ারা হয়ে আছে। কোলাহলে মশগুল জনপদের ঐ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে চক্ষুদ্বয় আমার মন্ত্রমুগ্ধের মতো চুম্বক স্পৃষ্টের মতো আকৃষ্ট হলো। ওদিক পানে তাকাতেই যেন মনে হলো স্বর্গীয় অপ্সরীরা তার মৃদু হাতের ইশারায় আমাকে তারই রূপের রাজত্বে অবগাহন করার জন্য পরম মমতায় দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তাই ঐ হাতছানির মূর্ছনায় মোহগ্রস্ত হয়ে ভোমরার মত গান গাইতে গাইতে ঐখানে গমনের অদম্য সিদ্ধান্তটা আমার উন্মত্ত হৃদয়কে কুরে কুরে খাচ্ছিলো। কিন্তু প্রকম্পিত হৃদয়ের এত অব্যক্ত অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করার মত উপযুক্ত কোনো অনুষঙ্গী না পেয়ে ঐখানে নিঃস্ব একা ভ্রমণ সারথি হতে মনটা আমার কেন জানি কোনো মতেই সাঁই দিচ্ছিলো না। কারণ ওখানকার অনিন্দ্য সৌন্দর্যের সীমাহীন ঐশ্বর্যে অবগাহিত হৃদয়ের যে সিঞ্চিত আনন্দ অনুরণিত হবে, তা যদি তাত্ক্ষণিক উত্ফুল্লতায় শেয়ার করার লোক না পাওয়া যায়, তাহলে তা খুবই এক একঘেয়েমি লাগবে। তাই দূর থেকে ঐ তাগড়া জোয়ান সতেজ সৌন্দর্যটা ছলছল চোখের চঞ্চল ভেলায় চড়িয়ে অতৃপ্ত মনকে কিছুটা বুঝ-শান্তি দিয়েই অনন্ত বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছিলাম। কিন্তু দিগন্ত জোড়া ঐ কারুকার্যের সেই চিরন্তন মালিক তার সৃষ্টির রহস্য উন্মোচোনের দীপ্ত শপথে মত্ত এই চঞ্চল মনকে যে কোনো মতেই নিরাশ করতে চাননি। কারণ কারো মনের প্রকৃত চাওয়া যে তিনি কখনোই অপূর্ণ রাখেন না। আর সেই কারণেই হয়তো তিনি আমার বাড়ি ফিরে যাওয়ার পথে সেই বিস্মিত নেত্রের নিষ্পাপ ইচ্ছা পূরণের উপায় বাতলে দিলেন। অর্থাত্ তাঁরই কুদরতি ইশারায় যেন আমি আমার এই মনের কোণে উত্থিত সেই দৃপ্ত আকুলতা বোঝার মত এক প্রিয় সঙ্গীর আকস্মিক অনুষঙ্গ পেয়ে গেলাম। অতঃপর সেই প্রিয়ভাজনের কাছে মনের আকুতি ব্যক্ত করতেই বন্ধু সুলভ ভাগিনা আমার ওখানে যেতে এক নিমেষেই রাজি হয়ে গেল। অর্থাত্ ঐ ভাগিনা হাসান যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায়ই ওর মোটর সাইকেলটা লক্ষ্য অভিমুখে ঘুরিয়ে নিলো। আর ওর ড্রাইভিংয়েই মূলত আমরা দুজন মোটরবাইক যোগে সেই অফুরন্ত সৌন্দর্যের চিরন্তন প্রতীক জাম গাছটার দিকেই নিঃশঙ্কচিত্তে রওনা হলাম। দুরন্ত মাঠের অফুরন্ত ধান ক্ষেত আর কাদায় মাখা তলা বিলের স্বচ্ছ কালো পানির মৃদু ঢেউ যেন ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের এক নিদারুণ রূপসী আস্তরণে পরিণত হয়েছে। তাই এরূপ একটা দুর্গম পথে বাইক নিয়ে যাওয়াটা কোনো মতেই সম্ভবপর ছিলনা। আর এ কারণেই আমরা রাস্তার পাশের এক পরিচিত বাড়িতে বাইকটা স্টান্টবাই করে রেখেই তবে এক পায়ো মেঠো পথ ধরে মূলত দ্রুত লক্ষ্য অভিমুখে হাঁটা শুরু করলাম। সরু আইলের উপর মাথা নোয়ানো সোনালী ধানের শিস আর নাম না জানা অসংখ্য বুনো ঘাসের তুলতুলে দেহ যেন পরম আদর আর মমতায় আমাদের পা দুখানি অনবরত চুম্বন করে চলেছে। এসব চুম্বনে শিহরিত হয়ে আমরা দুই মামা- ভ্যাগনে সন্তর্পণে পা ফেলতে ফেলতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম। কখনো কখনো সরু আইলের সাবধানী হাঁটায় মনোযোগ হারিয়ে আমাদের চক্ষুদ্বয়ের রেজুলেশন যতদূর যাচ্ছিল, সেখানে প্রতিফলিত হচ্ছিল শুধু সবুজাব সোনালী রঙের চিত্রায়নে চিত্রিত বিচিত্র জাতের ধান আর ধান। হঠাত্ চোখে পড়লো বিলের এক পাশের কালো পানিতে কিছু আধ-বয়সী লোক তাদের দুরন্তপনায় মত্ত ছেলেপেলেদের নিয়ে অতি উত্সাহী মেজাজে পানি সেঁচে মাছ ধরছে। পাশেই কিছু কৃষক আবার স্বতঃস্ফূর্ত খেয়ালে আচ্ছন্ন হয়ে বৈশাখী ফসলের জন্য অসামান্য নৈপুণ্যে মাচাং তৈরিতে কর্ম ব্যস্ত সময় পার করছে। জমির ধানগুলো আইলের পারে অনেকটা মাথা হেলিয়ে পড়েছিল। আর তাই আমরা কিছুটা অতি সাবধানতায় পা ফেলতে ফেলতে আবার কাঙ্ক্ষিত গাছটার নিকট পৌঁছানোর নিস্তব্ধ ব্যাকুলতা প্রকাশ করে যাচ্ছিলাম। নানান কথার দারুণ মজায় উচ্ছ্বসিত হয়ে অবশেষে দুই মামা ভ্যাগনে একেবারে গাছটার কাছে গিয়ে পৌঁছলাম।গাছটার পারি-পারশ্বিক মনোরম দৃশ্য আমি দূর থেকে যতটুকু ধারণা করেছিলাম, কাছে এসে মূলত তা আমার ধারণার চেয়েও বেশি মিলে গেল। সেখানকার মনোরম স্নিগ্ধ ছায়া চারপাশে এমন নিবিঢ় ঘনত্বে বিস্তার লাভ করেছে, যেন তা তপ্ত দুপুরের কাঠফাঁটা রোদে অশান্ত হৃদয়ের ভিতরে মুহূর্তেই বরফের মত ঠান্ডা হাওয়ার পরশ বুলিয়ে গেলো। এরপর অব্যক্ত অনুভূতি গুলো একসাথে প্রকাশ না করতে পেরে আমি একটু কিছুটা চঞ্চলতার আতিসাজ্যে স্থানটির এদিক ওদিকে দণ্ডায়মান অর্ধ-পাকা ধান ক্ষেতের ঐ নিবিঢ় সমুদ্র অভিমুখে স্থির দৃষ্টিতে তাকাতে থাকলাম। দেখলাম, সেটা কত অপরূপ মায়ায় সুদূর দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে এই নাবালক জামগাছটার নিবিঢ় ঘন ছায়ার পরিধির বাইরে বিস্তার লাভ করে আছে। আরো দেখতে পেলাম, সে মায়াবি ছায়ায় বসে তৃষ্ণার্ত পথিকের পিপাসা মেটাতে যেন একটা বোরিং এর ব্যবস্থাও ছিলো। অর্থাত্ সেখানে অবারিত ক্ষেতে জল সিঞ্চনের নিমিত্ত শ্যালো মেশিনের ভটভটি ব্যঞ্জনায় অনবরত পানি উঠছে তো উঠছেই। আমরা দুই মামা ভ্যাগনে স্নিগ্ধ ছায়ায় উত্ফুল্ল কিছু সময় কাটানোর পর ওইখানটেই ঘাস কাটতে আসা ঐ মজনু ভায়ের দেখা পেলাম। আমাদের দেখামাত্র মজনু ভাই ঘাস কাঁটা ফেলে রেখে আমাদের কাছে এসে হাজির। সে বিশ্রাম নিতে এসে নানা কথার মূর্ছনায় আমাদেরকে অদ্ভুত কিছু ভৌতিক কাহিনী শেয়ার করতে থাকল। অর্থাত্ সেখানে ঘটা কিছু অস্বাভাবিক ভৌতিক কাহিনী সে আমাদের সামনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তুলে ধরল।

হিমু মামু ছিল গাছসহ এই বরিং এর মালিক। তাই হিমুর অনুরোধে আমার রিজাল ভাই কোনো এক চাঁদনি রাতে ঐ বরিং পাহারা দিচ্ছিল। পাহারা দেবার মাঝে সে এক সময় জাম গাছের তলে নাকি সাদা জামা গায়ে একজন লোক দেখতে পায়। ওকে দেখে রিজাল ভাই একটু দূরে অবস্থান করে। এক সময় লোকটা বোরিং এর পানি দিয়ে ওজু করে গাছটির সামান্য একটু দূরে ঘোরাফেরা করে। এইফাকে রিজাল ভাই মেশিনটা বন্ধ করতে আসে। তত্ক্ষণাত্ লোকটাও গাছের কাছে এসে রিজাল ভাইকে ডেকে বলে, এই আপেল খাবি? এ কথা শুনে রিজাল ভায়ের তো সীমাহীন ভয়ে আর পা-ই ওঠে না। তার গায়ের মধ্যে ছমছম করে বাজতে থাকে কিছু অযাচিত ভয়। ভয়ঙ্কর ঐ অভিজ্ঞতার অনুষঙ্গী হয়েই রিজাল ভাই তড়িঘড়ি করে বলে ফেলে, খাব দেন। তারপর লোকটা হাতের উপর আপেলটা দিয়ে বলল, তোর মনে হয় একা বাড়ি যেতে ভয় করবে। চল, তোকে এগিয়ে দিই। এরপর রিজাল ভাই পিছনফিরে হাঁটা শুরু করলে লোকটা ভাইকে তার জনপদের কেনাল পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। রিজাল আমার খালাতো ভাই হয়। আমার বাড়ির সাথেই ওর বাড়ি। ওর সম্পর্কে আমার যতদূর ধারণা, ও কখনো ফাও বা অতিরঞ্জিত কোনো কথা বলে না। সহজ সরল প্রকৃতির এক গ্রাম্য নিরক্ষর মানুষ। তারপরও সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আমি রিজাল ভাইকে এ ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। ভাই আমার ঠিক ওভাবেই পায় টু পায় বলতে থাকে যেভাবে আমরা শুনেছিলাম। যাইহোক, এতক্ষণ ভাগিনা হাসানের মুখে উচ্ছলতার এক অকৃত্রিম ছাপ জড়িয়ে থাকলেও মুহূর্তেই তা যেন কাল মেঘের ভয়াল আস্তরণে পর্যবসিত হলো। আর এসব শুনে দ্বিতীয়বার সে এখানে আবার আসবে বলে মনে হলো না। 

অর্থাত্ এখানে আমরা পিকনিকসহ নানা প্রগ্রামের বাস্তবায়ন করব বুলে এতক্ষণ খুবই সরব ছিলাম। অথচ ওদের মুখ নিঃসৃত এসব ঘটনা শোনার পর, আমাদের মুখটা যেন কেমন জানি অন্ধকারের কালো মেঘে ছেয়ে গেল। এরপর মজনু ভাই আবার বলতে থাকে, ওখানে নাকি গভীর রাতে ঘোড়া দৌঁড়ে গিয়ে কোথায় গিয়ে যে মিলিয়ে যায় তা আজও কেউ খুঁজে পায়নি। "আলাভুলা" নামের কি যেন একটা মন্ত্রমুগ্ধতায় বুঁদ হয়ে কেউ কেউ নাকি পথ ভুলে দিগ্বিদিক মাইলের পর মাইল হেঁটে চলে যায়। অথচ সে নিজেও জানতে পারে না কার হাতছানিতে সে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। পাশ থেকে হিমু মামু আবার বলে ওঠে, আমন ধান নিয়ে চাষিরা যখন গুরুর গাড়িতে করে বিল মাড়িয়ে রাস্তায় ওঠার চেষ্টা করে তখন হঠাত্ কোন কাদা নাই কিছু নাই এমনিতেই ঐ গাড়ির গোরুগুলো তাদের স্বাভাবিক হাঁটা থামিয়ে দেয়। এক পাও তারা আর সামনে এগুতে পারে না। তখন চাষীরা নিরুপায় হয়ে গাড়ির জোয়াল থেকে গরু ছাড়িয়ে নিয়ে অনেক দুয়া কালাম পড়লেই তবে আবার গরুগুলো স্বাভাবিক ভাবে গাড়ী টানতে শুরু করে। ওদের কথা শেষ না হতেই, আমিও তৎক্ষণাৎ আমার এরূপ একটা অভিজ্ঞতা লব্ধ ঘটনা সেখানে বর্ণনা করার প্রয়াস পাই। আর সেটা হলো, একদিন আমি আর আমার এক ভাগ্নে জাহিদ রাতের খাবার পর হাঁটতে বেরুলাম। এরপর মনের অজান্তেই আমরা রাত এগারোটার দিকে এ বিলের ধারের জনপদের রাস্তায় বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ দেখি বিলের ওইপার থেকে ল্যাম্পের মাথার নীলাভ বর্ণের মতো বড় একটা গোলাকার আলো ঘুরতে ঘুরতে আমাদের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। সেটা দেখে আমি প্রাথমিক ভাবে স্বাভাবিক থাকলেও জাহিদ তো হঠাত্ অজানা ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে একেবারে লাফ দিয়ে ওঠে। এরপর ওইখান থেকে আমরা উঠে পড়ার পর আলো স্বাভাবিকভাবে মিলিয়ে যায় আর আমরাও ওখান থেকে বাড়ি ফিরে আসি।


যাইহোক, এরূপ অনেক গল্প-কথার পর আমাদের এবার ফেরার সময় হলো। ফেরার সময় কি যেন একটা শঙ্কা আমাদের ভিতর কাজ করছে। কেননা, আমরা যতটা উচ্ছলতা নিয়ে সেখানে গিয়েছিলাম, ঠিক ততটাই বিমর্ষতা নিয়ে ওখান থেকে আমাদের ফিরে আসতে হচ্ছে। সেইসঙ্গে ঐ স্থানটাকে নিয়ে আমরা দুই মামা ভ্যাগনে যতটা প্ল্যান পরিকল্পনা করছিলাম, তার সবটাই যেন এক নিমেষেই ভেঙে চুরে চুরমার হয়ে গেল। তবে এতো কিছুর পরও, ঐ সুন্দর পরিবেশে পিকনিকের আশা কিন্তু আমরা আজও ছেড়ে দেইনি। যাইহোক, ঐ দিনকার মতো আমরা দুজন কিছু আজব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে অবশেষে আনমনে কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা আউড়াতে আউড়াতে বাড়ি অভিমুখে ফিরে এলাম।

Comments

Popular posts from this blog

খুঁজে ফিরি সেই গ্রাম