বিড়ম্বনার এক দিন
বিড়ম্বনার এক দিন
মোঃ এনামুল হক
ভোর ছটা বাজে। ডাইরেক্ট গাড়ি না থাকায় ভাবছি আজ কঠোর লকডাউনে লোকাল যানবাহনে ভেঙে ভেঙেই বাড়িতে যাব। ভোরের পাখির টাটকা কিচিরমিচির কুহুতানে আমার ঘুম ভাঙ্গার আগেই ম্যানেজার সার ও করিম সার একই বাইকে কুষ্টিয়া থেকে যশোরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন সেই সাত সকালে। তবে আমি ঝিনাইদহ যাব বলে রুম থেকে অন্যদের চাইতে পরে হলেও আমার চাইতে একটু আগেভাগেই বের হলাম। রাতে এনে রাখা দুটো কেক রুটি আর মাম বোতলের দু ঢোক পানি খেয়ে নিলাম। এরপর বেসিনে সাবান দিয়ে কোরোনার নিয়মে হাত-মুখ ধুলাম। এরপর আমার পরিচিত সেই কালো ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে রওনা দেবার জন্য রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। সারা রাতের ভারি বৃষ্টি ঘুমের গভীরতায় বিস্মৃত থাকলেও সকালের ঝিরিঝিরি ধারার ঘনফোটের বৃষ্টি আর রুমের সামনে জমে থাকা হাঁটু সমান পানি জানিয়ে দিল কি পরিমাণ বৃষ্টি সারারাত হয়েছে। সারা আকাশে মেঘের আস্তরণ যেন মহাকালের অবিরত চাকাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য থমকে দিয়েছে। দরজায় দাঁড়িয়ে বাড়িতে ফেলে আসা ছাতার বেখেয়াল চিন্তায় বৃথা সময় নষ্ট না করে মাথার উপর ব্যাগটা রেখেই ছোট্ট একটা দৌড়ে মেইন রাস্তার ধারে এক দোকানের ছাউনিতে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। শা শা করে দুটো মোটর সাইকেল আরোহী বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে আমার পাশ ঘেঁষে তুমুল বেগে ছুটে গেলো। আনমনে মটর সাইকেল না থাকার আফসোসটাও মনের ভিতরে কখন জানি একটু স্নায়ু ক্ষরণ করে গেলো। স্বল্প পরিসরের ঐ ছাউনি থেকে বৃষ্টির হেয়ালিপনায় আমি যেন কোনোমতেই নড়াচড়া করতে পারছি না।
এরপর একটু কষ্টসহিঞ্চু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাত্ দেখতে পেলাম বৃষ্টির ঘনঘটায় আমার সমস্যাটা বুঝতে পেরে দূর থেকে কে যেন একটা ছাতা মাথায় নিয়ে আমার দিকেই হনহন করে এগিয়ে আসছে। বেসামাল বাতাসের ঝাপটা মিশ্রিত বৃষ্টির অস্পষ্ট বর্ষণেও চিনতে কষ্ট হলো না যে, ও আমাদেরই অফিস স্টাফ তপু নামের সেই চঞ্চল ছেলেটা। "সার, বৃষ্টি তো আপনাকে একেবারে ম্যানকে চিপায় ফেলে দিয়েছে। ছাতার ভেতরে আসেন বুথের ওখান থেকে রিক্সা পাবেন।" মৃদু হাসির তপুর এই রসিকতায় সাড়া দিয়ে চট জলদি তপুর ছাতার তলে আমিও আশ্রয় নিলাম। "হোম কোয়ারামটাইন ছেড়ে একটু রেইন কোয়ারামটাইন কাটাইতে চাইলাম। তাও তো তুমি হতে দিলা না।" ওর রসিকতার উত্তর দিয়ে ছাতার নিচে দুজনা ছোট ছোট কথার বুননে বক চত্বর আমাদের বুথের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ওখান থেকে তপু আর রাছেল মিলে আমাকে একটা রিক্সা ঠিক করে দিল চৌড়হাস পর্যন্ত যাবার জন্য।
এরপর চৌড়হাস নেমে আর গাড়ি পায় না। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বহু কাঙ্ক্ষিত একটা অটো রিকশা পেলাম। ফলে নিরব প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে আমি চটজলদি তিন চার জনের মধ্যে ঠেসাঠেসি করেই বসে পড়লাম। একটু পরেই আমারই পাশের ছিটে বসা মধ্যবয়সী এক নারীর কন্ঠে করুন বিলাপ মিশ্রিত ফুঁপিয়ে কান্নার সুর ভেসে আসল আমার কানে। "মা আমার.... কাল রাতেও আমাস্সাতে ফোনে কথা বলিছে রে.....। সমেস্যা থাকলি তো ও আমার কাছে কতো। ওরা ষড়যন্ত্র করেই আমার মেয়েডারে মেরে ফেলিছে রে....।" "পুলিশ বাদী কেচ হবিনি.... তুরা কি ভাবতিছিস?" থমথমে নিরাবতায় হঠাত্ এভাবেই এক পুরুষের কন্ঠস্বর ভেসে আসলো আমার কানে। এতক্ষণে মূলত আমি বুঝলাম এতো সকালে কেন আমি এই রানিং অটোটা এতো সহজে পেয়ে গেলাম। স্বামীর অত্যাচারে মৃত মেয়ের লাশ দেখতে যাওয়া মানুষগুলোই যে আমার সহযাত্রী তা প্রথমে বুঝতে না পারলেও এখন আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। যাইহোক, অটোটা সর্ব সাকুল্যে আমার বিত্তি পাড়া পর্যন্ত পৌছে দিতে পারলো। আর বিত্তিপাড়া বাজারে আমাকে ড্রপ করেই অটোটা তাড়াতাড়ি নিজ গন্তব্যের পথে চলে গেলো।
মেইন রোডের পাশে দাঁড়িয়ে ঝিনাইদহ অভিমুখের কোন একটা গাড়ির খোঁজ করতে লাগলাম আমি। রাস্তায় যাত্রীবাহী গাড়ির কোন বালাই নেই। তবে বেলা বাড়ার সাথে সাথে অবশ্য রাস্তায় কিছু পিকআপ ভ্যানের আনাগোনা বেড়েই চলল। এই সুযোগে আমি যেকোনো এক সহৃদয়বান ড্রাইভারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু দশ বার বার হাত উঁচিয়ে সিগন্যাল দিলেও কেউ তাতে একটা বারের জন্য সাড়া দেবার মনোভাবই পোষণ করল না। ছোপ ছোপ বৃষ্টি আর ভয়ঙ্কর মেঘের ভারী বর্ষণের আলামত আমার উত্কণ্ঠা আরো বাড়িয়ে তুললো। এরপর অনেক অপেক্ষা আর চেষ্টার পর অবশেষে আমার করুণ জিজ্ঞাসায় এক পিকআপ ভ্যান চালক কেন জানি তার গাড়ি থামানোতে সুমতি হলো। আমি জলদি চালকের পাশের সিটে বসতে উদ্যত হলাম। কিন্তু ভিতরে জায়গা নেই বলে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন। তবে উপরে উঠলে উঠতে পারি বলে তিনি আমাকে শেষ অফার দিলেন। কি আর করার, অগত্যা কোনো উপায় না পেয়ে পিকআপ ভ্যানের উপরেই উঠতে হলো আমার। কাদা আর বৃষ্টি মাখা পিচ্ছিল গাড়ির ওয়াল বেয়ে কোনো রকম বুকে হিঁচড়ে ভিতরে গিয়ে পড়লাম। সবজির ভাড়া মারা ঐ পিকআপ ভ্যানের ভিতরে দেখতে পেলাম কর্দমাক্ত এক মোটা পলিথিন গড়াগড়ি খাচ্ছে। তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্তে হাতের ব্যাগটা মাথার উপর দিয়ে একটা টায়ারের উপর নিজেকে কোনোরকম বসিয়ে পথ চলতে থাকলাম।"ভাই আপনি কোই যাবেন?" পলিথিনের ভিতর থেকে হঠাত্ আওয়াজ আসলো। আমি আনমনে হতচকিত হয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,"আমি ঝিনাইদহ যাব ভাই।"
আমি কথা বাড়ানোর সুযোগ পাওয়ার আগেই উনি গড়গড় করে বলতে থাকে "আমি পাবনা থেকে ভেঙে ভেঙে আসছি। বিপদে পড়ে আমিও আপনার মত এখানে আশ্রয় নিয়েছি। বৃষ্টির প্রকোপ বাড়তেই থাকবে ভাই। আমার মতো কাগজটা মাথায় দিয়ে বসেন।" পিকাপ ভ্যানের পলিথিনের নিচে বসে থাকা ঐ আগন্তুকের সাথে সাময়িক পরিচিতটা মনে হলো অনেক দিনের। তীক্ষ্ম বৃষ্টির সাথে ঝাপটা বাতাস যেন ফুল স্পীড গাড়ির গতির সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের গায়ের উপর এসে পড়ছিল। বন্ধুর রাস্তার নিষ্ঠুর ঝাঁকুনি যেন আমাদেরকে সর্বদা ছিটকে ফেলার এক প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় ব্যস্ত। পলিথিনের অবগুণ্ঠণ থাকায় পরিচিত রাস্তার কোন মোড়ে যে কোন বাজার অতিক্রম করছি তা আন্দাজ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তবে চড়োর বিল থেকে আরো এক জন হতভাগা হাত মেরে গাড়ি থামিয়ে আমাদের মতো করুণ অবস্থা বরণ করায় গাড়ির অবস্থান প্রথম বারের মত জানতে পারলাম। তবে আমাদের পাশে খোসাখুসি অবস্থা থাকায় ও লোকটি আরেকটি কর্দমাক্ত নোংরা পলিথিনের নিচেই মাথা ডোবালো। তবে লোকটা যখন ভাটই বাজার নামার জন্য গলা ছাড়ল তখনই বুঝলাম আমাদের শাস্তির মেয়াদ প্রায় শেষ হতে চলেছে। অনেক ঝক্কি ঝামেলা আর ভাঙ্গা রাস্তার নিষ্ঠুর ঝাঁকুনির কষ্ট সহ্য করার পর পিকাপটি অবশেষে থামল ঝিনাইদহ ফায়ার সার্ভিসের সামনে। মোটা পলিথিন মাথার উপর থাকায় এতক্ষণও পুরা শরীর ভিজে নাই। কিন্তু নামার সময় গোছল হওয়া থেকে আর রেহায় পাওয়া গেলো না। পাবনা থেকে আসা ভাইটি তার পাশ দিয়ে তো সহজেই নামতে সক্ষম হলো। কিন্তু আমি ঝাঁপ দিয়ে পিকাপ থেকে নামার সময় পানির ড্রেনের অস্তিত্ব বুঝতে না পারায়, পা পিছলে সরাত করে পড়ে গেলাম পানিভরা গর্তে। যাইহোক, এবার পূর্ণ হলো গোছোলের ষোলকলা। তারপরেও পুরো ধারার বৃষ্টিতে নিরুপায় ভিজতে ভিজতে রাস্তার হাঁটু জলে দৃশ্যমান শুধুমাত্র কয়েকটা ইটের উপর দাঁড়িয়ে পানিতে চোবানো ভারি জুতো আর ব্যাগ ভরা হাত কোনো রকম সামলিয়ে ড্রাইভারকে তার নির্ধারিত ভাড়াটা দিতে সক্ষম হলাম।
Comments
Post a Comment