ঈদ আর নয় মহা-বিচ্ছেদ

ঈদ আর নয় মহা-বিচ্ছেদ 

মোঃ এনামুল হক 


পরিচিত ভায়ের শীর্ণ ভ্যানের পিছনে বসে ভাঙাচুরা রাস্তার খড়বড়ে কাপুনির তরঙ্গে আর বাতাসের শো শো শব্দের মিষ্ট আওয়াজের সাথে সামনের দুই যাত্রির অস্পষ্ট কথোপকথনে পিছনে বসা লোকটার কানে ভেসে আসলো,“ মালা দিয়ে কি সুমুদ্দুর ছেকা যায়?” আঞ্চলিক ভাষায় নারিকেলের ভিতরের শক্ত খোলসের অংশকে ‘মালা’ বলে আমাদের অঞ্চলে। কৌতুহলবশত, খুব কষ্টের মাধ্যমে আলোচনার বিষয়টি অনুধাবন করার চেষ্টা করে অবশেষে লোকটা বুঝতে পারলো ভ্যানের সামনে বসা লোক দুইটা পদ্মা সেতুর নিগুড় তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করছে।উপদ্রবের মত পেছনের লোকটি তখন আবার মুখ ফোঁসকে বলে ফেললো, “আপনারা যেকোন কিছুর উন্নয়ন নিয়ে সবসময় আমাদের দেশের বিরোধী দলের মত শুধু বিরোধীতার জন্যই বিরোধিতা করেন কেন,যা হচ্ছে হোক না। আমরা তো এই পাড়েরই লোক...এই পাড়েই আমাদের বসবাস,ব্রিজটি হলে ক্ষতি কি...বরং উপকার তো আমাদেরও । ব্রিজটি দিয়ে শুধু তো সরকার দলের লোকেরাই যাবে না, ওটা দিয়ে তো আমরা  সবাই যাতায়াত করবো। ভাবটা এমন যে ওটা না হলেই যেন কারো কারো চোখে মুখে ঈদের খুশির অবারিত ঝলকানি রীতিমত ফুটে ওঠে।”স্বমতের বিরুদ্ধ মতবাদের অযাচিত সুর শুনে খানিকটা বিরক্ত হয়ে লোকটা অতি কষ্টের সাথে ট্যাশ ট্যাশ করে বলে উঠল, “আরে বাপু, উন্নয়ন মারাচ্ছে। কোটি কোটি টাকা খাওয়া-খাওয়ি হয়ে গেল এই ব্রিজ বানানো নিয়ে আর তুমি দেখছো উন্নয়ন। টাকা খায়ে খায়ে এখন আবার শুনছি প্রধাণমুন্ত্রী নাকি নিজির টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু বানাবে। হাস্যকর কথা। আচ্ছা, তুমিই কও মালা দিয়ে কি অসীম সুমুদ্দুর ছেকা যায়? একটা পাগলের প্রলাপ বকা নাই!” অর্থাৎ তার মতে বাংলাদেশের মত গরীব দেশের পক্ষে পদ্মা সেতুর মত এত বৃহৎ একটা প্রকল্প বাস্তবে রূপ দেওয়া কোন ভাবেই সম্ভব নয়। তখন পেছনের লোকটা বললো, সে সময়েই বলে দেবে কি হবে কি না হবে। ঘোষণা পর্যন্ত অন্তত বিশ্বাস রাখি। যখন না হবে তখন তীক্ষ সমালোচনার তীর ছুড়ে তুলো ধুনা করা যাবে। তবে আমি নিরাশ হয়ে হতাশাবাদীদের খাতায় নাম লেখাতে এখনই রাজি নই। পায়ে চালিত ভ্যানটা বাজারে পৌঁছানোর কিছু পূর্বেই পথিমধ্যে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ফলে রাস্তার পাশে এক ছাউনিতে যাত্রীরা সবাই আশ্রয় নেওয়াতে সময় কাটানোর জন্য উত্থিত প্রসঙ্গটা আবার প্রলম্বিত করার দারুন একটা সুযোগ পেয়ে গেল লোকটা। ভাইজান সম্মোধন করে বলে উঠল, আপনি বড় পরিসরের কথা বাদ দেন, আমাদের ছোট্ট গ্রামের কথাটাই একবার ভাবুন।এই ক্ষুদ্র গ্রামটায় এই  অসংলগ্ন মতাবলম্বনের জন্য গ্রাম্য রাজনীতির কি ঘৃণ্য চিত্র ফুটে উঠেছে তা নিশ্চয় আমাদের কারো অগোচরে নয়! আর কেন জানি সেই ঘৃণ্য গ্রাম্য রাজনৈতিক চিত্রটার নগ্ন আত্মপ্রকাশ আমাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা গ্রাম্য মানুষের সরল বিশ্বাস নিয়ে মেতে ওঠে তা কোনভাবেই আমার বুঝে আসে না। কেন ভাই তাকওয়ার ভিত্তি বাদ দিয়ে শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য গ্রামে দুইটা মসজিদ নির্মাণ হয়, দুইটা ঈদগা নির্মাণ হয় অথচ সেখানে দুইটা স্কুল কেন নির্মিত হয় না? হিংস্র জানোয়ারের অন্যতম চরিত্র হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানোর ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হয় কিন্তু মনুষ্যত্ব বিনির্মাণের প্রধাণ হাতিয়ার বিদ্যার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হয়না কেন? কেন আমরা দিনদিন দলকানার পরিচয় দিতে গিয়ে মনুষ্যত্বহীনতার সর্ব নিম্ন স্তরে চলে যাচ্ছি? আমরা যদি এত দলকানাই হবো তাহলে সেক্ষেত্রে আমাদের প্রাইমারি স্কুলটাও কেন দলীয় আবরণ দিতে বাকি রাখছি? কেন সেখানে স্ব স্ব দল-মালতের স্কুল কলেজ আমরা নির্মান করছি না। যার যার দলের ছেলেমেয়েরা তার তার দলের স্কুলে পড়বে যার ফলে দলীয় শিক্ষার বাতাবরণে তাদের বিদ্যার চর্চাটাও লোক দেখানো ধর্ম চর্চার মত তুঙ্গে উঠে যাবে। আর তাতে গ্রামের ছেলেমেয়েরা একাধিক স্কুল-কলেজের সান্নিধ্যে এসে প্রকৃত জ্ঞানার্জন করে সঠিক পথের দিশা লাভ করবে ভালো করে আর ফলশ্রুতিতে সমাজ থেকে অন্তত আর যায় হোক হিংসা-বিদ্বেষটা তো চিরদিনের জন্য নিপাত হয়ে যাবে। শুধু শুধু ঈদগা মসজিদই কেন যুগে যুগে টুকরা টুকরা করতে হয়? আসল জায়গায় হাত না দিয়ে শুধু ঈদগা আর মসজিদ ঘরকে দু টুকরা করার চিন্তা আপনাদের মাথায় বারবার ঘুরপাক খেলে কেন আর তার সদুত্তরই বা কেন আপনারা আমাদের মত নগন্য নশ্যি পিপলকে দিয়ে একটু ধন্য করেন না? আচ্ছা মানলাম মসজিদ ঘর না হয় চরম প্রয়োজনের পরম আবশ্যিকতার অনুভবে সাড়া দিতে গিয়ে দুই পাড়ায় দুইটা নির্মাণ করা হল ভাল কথা , তাই বুলে কেন প্রাচীন ঐতিহ্যভরা মহামিলনের চিরপরিচিত স্থান প্রাণের  ঈদগা ময়দানটাকেও দুই টুকরা করতে হল? কেন ভাই,কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগা ময়দানে কি লক্ষ লক্ষ মানুষ একসাথে নামাজ পড়ে না? অথচ আমরা কেন এই মায়ামাখা ছায়াঘেরা ছোট্ট গ্রামের মাঝে এত বিভেদ বছরের পর বছর জিইয়ে রেখে দিই? আমরা কত মানুষ প্রতি বছর নাড়ির টানে কেউ বিদেশ থেকে বাড়ি এসে অথবা কেউ দূরদূরান্তের চাকরি বাকরি থেকে বাড়ি ফিরে কত বন্ধুদের সাথে বছরের পর বছর কুলাকুলি করতে পারি না শুধু এই দুই জায়গায় ঈদের নামাজ পড়ার কারণে। কিন্তু কেন আমরা আবার আগের মত এক জায়গায় নামাজ পড়তে পারি না। তাহলে কি বলব আমাদের এই অত্যাধুনিক সভ্যতা আজ অসভ্য বর্বর যুগের চাইতেও একদম নিচে নেমে গিয়েছে? প্রত্যক্ষ  করেন ভাইজান, আমরা গ্রামের সবাই একই সাথে মিলেমিশে একই মাঠে কৃষিকাজ করছি, একই দুকানে বসে সবাই প্রত্যহ স্বানন্দে আড্ডা দিচ্ছি আর চা খাচ্ছি,একই ঘাটে সকাল বিকাল গোছল করছি, একই রাস্তায় একই যানবাহনে চড়ে সবাই বাজারে যাচ্ছি,এপাড়া ওপাড়া ছেলেমেয়ে বিয়ে দিয়ে আত্মীয়তা করছি, কিন্তু মাগার আমরা নামাজটা কেবল এক জায়গায় আদায় করলেই যত্তসব বিপত্তি বেধে যাচ্ছে। এখানে অবশ্য কিছু জ্ঞানপাপী সামাজিক কিটের কুপরামর্শে বাঁশের শাকো বানিয়ে রাস্তাটাও দুই দিকে চালনা করার চেষ্টাও চলছিল, কিন্তু বোঝেন তো উপরোয়ালার এতে একেবারেই ইচ্ছা নেই যেকারণে ঐ হীন কুপরামর্শের সঠিক বাস্তবায়ন আর পথ খুঁজে পায়নি। শাকো ঠিকই দুদিন পরে ভেঙ্গে পড়ল আর আবার সেই পূর্বের রাস্তা ধরেই ভ্যানে চড়ে আমরা এখন একসাথে বাজারে যাচ্ছি। মসজিদটা না হয় কারো ব্যক্তিগত চুলকানিতে কিছু সরল নিরীহ মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে সুবিধাবাদীদের নিজের এলাকায় সুবিধামত পজিশনে তৈরি করে নিল কিন্তু ঈদগাটা তো অন্তত মানিয়ে গুছিয়ে একই স্থানে করা যেত। সুবিধাবাদী জ্ঞানপাপী যেসব কুচক্রীমহলের নেতৃত্বে বা সুদূরপরিসরী নিকৃষ্ট উদ্যোগে যে মসজিদ তৈরি হল তা নির্মানের জায়গাটা কিন্তু সুকৌশলে তাৎক্ষনিক আবেগকে কাজে লাগিয়ে কিছু সরল নিরীহ মানুষের কাছ থেকেই বাগিয়ে নেওয়া হয়েছে। সরলমনা ঐসব নিরক্ষর জমিদানকারী চাষী ভাইদের কিছুদিন নামমাত্র মসজিদ কমিটির সভাপতি, ক্যাশিয়ার অথবা মুয়াজ্জিনের মসনদে অভিসিক্ত করেই আবার মীর জাফরের মত করে কদিন বাদেই বউ তালাকের ফতোয়া বাতলিয়ে বা গ্রাম্য রীতির অন্য কিছু উদ্ভট ছুতোর কারন দেখিয়ে নিমিষেই ছুড়ে ফেলা হয়েছে। আবার পরক্ষণে সেই চৌকস সুবিধাবাদী জ্ঞানপাপীরাই মসজিদ কমিটির চালকের আসনে আসীন হয়েছে। নতুন মসজিদ নির্মানের সুবিধাবাদী মেন্টরদের আগে কখনই অন্যরা পুরোনো মসজিদ প্রাঙ্গনে তারাবি পড়তে যেতে দেখিনি অথচ পাশের বাড়ির সরল সোজা মানুষগুলো সবসময়ই পুরানো মসজিদে তারাবি পড়ে এসেছে। না বোঝার কারণে হয়ত অনেকেই একসময় এদের সাথে পাশের খানকায় বা কারো ঘরের বারান্দায় তারাবি আদায় করেছে। দীর্ঘ দিনের লালিত সপ্নের বাস্তব রূপ দিতে গিয়ে কোন প্রকার তাকওয়ার ধার না ধেরেই এরা রাজনীতির ঘৃণ্য ম্যারপ্যাচকে কাজে লাগিয়ে শান্তির প্রতীকটাকে হিংসার চিরস্থায়ী প্রতিক হিসেবে ঐ মসজিদ নির্মান করে ফেলল। অথচ সেসময় হয়ত কখনই তাদের দূরভিসন্ধির কথা কেই জানতেই পারেনি। তাহলে দেখুন, এখানে কি চমৎকার (সু)কৌশলের ব্যাপার: তারা খুব ভালো করেই জানে মসজিদে কেউ একবার জমি দান করলে তা কখনোই সে ফেরত নিতে পারে না এবং মসজিদটাও ঐ স্থান থেকে কেউ সরানোর দু:সাহস রাখে না এটাই স্বাভাবিক বরং ধর্মীয় অনুভূতি উস্কে দিয়ে আশপাশ থেকে আরও জায়গা জমি দখলে নেওয়া খুবই সহজ ব্যাপার। অথচ মরণদশা হল নিরিহ অসুবিধাভোগী সাধারণ পাবলিকের। কারণ তাদের ঈদের নামাজ বা জুমার নামাজ পড়তে আসতে হয় শত্রু শ্রেণীর দেউড়ি মাড়িয়ে।কি বিশ্রী দেখায় যখন দলীয় বিভেদ স্পষ্ট করে এপাড়ার লোক ওপাড়ায় ওপার লোক এপাড়ায় নামাজ পড়তে আসে। আর নতুন মসজিদের সুবিধাবাদী জ্ঞানপাপীরা নামাজের পাটিতে বসে মিটমিটিয়ে হাসে আর মনে মনে তৃপ্তির ঢেকুুর তুলে বলে, হায়রে দলকানা আবেগী বাঙালী তোরা আজও কিছু বুঝলিনে। ভোটের কোন্দলসহ যেকোন কোন্দল কেন এরা সব জায়গা বাদ দিয়ে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে বেশি করে আনয়ন করে তা বিবেকবান মানুষের বুঝে আসে না। নাড়ির টানে যেসব আমজনতা উদভ্রান্তের মত নানা চড়ুই উতরাই আর ঝক্কি ঝামেলা পার করে বছরের একটা দিন আসে ঈদের নামাজ পড়তে গ্রামের বাড়িতে আর তারা যদি এসে দেখে গ্রামের ঘৃণ্য রাজনীতির বেহায়া আচরণ ঈদের নামাজের মত পবিত্র বিষয়টাকেও কলুষিত করে ফেলেছে তাহলে যে তারা পরবর্তিতে গ্রামে আসার আগ্রহই হারিয়ে ফেলবে সেটা জেনে কার কি আসে যায়। আর তাতেই বা কার কি আসে যায় যে এ অবস্থায় গ্রামের কিছু প্রজ্ঞাসম্পন্ন মানুষও শহরমুখী হয়ে পড়বে যা ইতিমধ্যেই ঐ প্রবণতা প্রকাশ করতেও শুরু করেছে। আগে এক কাঠের খাটলায় সারা গ্রামের মৃত দেহ সবাই মিলে বহন করা হয়েছে আর এখন দুই মসজিদের দুইটা চাকচিক্যময় স্টিলের খাট, মসজিদে টাইচ, ডিজিটাল মাইক্রোফোনে হুজুরের বয়ান কিছুতেই যেন মনে শান্তি আনে না। দলীয় স্বার্থের নামে যারা ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারের দীর্ঘস্থায়ী বিভেদের রাস্তা পাকাপোক্ত করেছে তাদের জানায় শত ধিক। ঈদ মানে না মহামিলন, অবারিত খুশি, নি:কলুষ আনন্দ! কিন্তু ঈদ মানে যারা মহা বিচ্ছেদ বানিয়ে রেখেছে আল্লাহ তাদের হেদায়েত দিক, জ্ঞান দিক এই কামনায় করি অন্তরের গভীর অনুভূতি থেকে। আমরা কখনই বিভেদ চায় না আমরা চায় যেকোন মূল্যে গ্রামের সকল মানুষের হৃদয়ের অটুট বন্ধন আর সুদৃঢ় ঐক্যের সীমাহীন উচ্ছ্বাস। আসুন আমরা সকল বিভেদ ভুলে গিয়ে আবার আগের মতন এক খাটলার মরণযাত্রী হই, ভালবাসা আর সাম্যের বাতাবরণে ঈদের মাঠে কুলাকুলি করি। আবার সবাই একসাথে সেই গড়ের মাঠে ফুটবল খেলি, ক্রিকেট খেলি। পচা গ্রাম্য রাজনৈতিক খেলা বাদ দিই। মানবতার বিবেক এবং তরুন যুবসমাজের অদম্য স্পৃহা একসাথে মিলে সেই কুচক্রীমহলের ব্যক্তি স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিই ।

Comments

Popular posts from this blog

কঠোর লকডাউন

করোনা উপলব্ধি

সিলেটে প্রথম দিন (ভ্রমণ কাহিনী)