সন্তানের মূল্যবোধ ও আমরা!
সন্তানের মূল্যবোধ ও আমরা!
মো: এনামুল হক
আপনাদের সাথে একটা জিনিস আমি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে শেয়ার করতে চাই। আর সেটা হলো, আমরা আমাদের নিজেদের সন্তান-সন্ততিকে নিয়ে যাতে খুব ভালমত চিন্তা করতে পারি। আর সেই সাথে ইসলাম যেন আমাদের সকলের জীবনে খুবই সচেতনতার একটা ব্যাপার হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমার উপর রাগ বা অভিমান হলেও, আজকে থেকে আপনি অন্তত কিছু একটা শুরু করুন। আর একদম কিছুই যদি আপনি না করেন; তাহলে সেটা নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য খুবই একটা চিন্তার বিষয় হবে। প্রত্যেকটি বাচ্চা যারা সৃষ্টি, স্রষ্টা বিভিন্ন বিষয়ে সন্দেহ করা শুরু করে অথবা যারা আল্লাহর কালেমা থেকে ভিডিও গেমস নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। তাহলে এটা আমাদেরই বিশাল একটা ক্ষতি এবং চিন্তার বিষয়। আপনাদেরকে আমি যেটা বলতে চাই সেটা হচ্ছে, মূর্তি বা আইডল। ইব্রাহিম (আ:) মূর্তি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। আমাদের সেই সমস্যা নেই। আমাদের এখানে মূর্তি নেই। সেই কোর্স নেই। আর আমরা এটা নিয়ে চিন্তিত না যে, আমাদের সন্তানরা কোন মূর্তি পূজা করবে। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে, আসলে আইডলটা কি? প্রত্যেক প্রজন্মের একটা নিজস্ব আইডল আছে। প্রত্যেকটা সময়ের একটা নিজস্ব আইডল আছে। আমাদের আজকের সময়ের আইডল হচ্ছে....ও আরেকটি ব্যাপার বলে নিই। আইডল হচ্ছে এমন একটা জিনিস; যা আপনি করেন সেটার সাথে আপনার আশা-আকাঙ্ক্ষা ওতেপ্রাতভাবে জড়িত থাকে এবং যেটার পূজা আপনি হর হামেশাই করে থাকেন। অর্থাত্ এটা এমন একটা জিনিস যেটা আপনার হৃদয়ে আল্লাহর স্থান দখল করে রেখেছে। আর এটাই আইডল। এখনকার সময়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রযুক্তি আমাদের কাছে বড় একটা আইডলে পরিণত হতে পারে। আমাদের এই সময় সন্তানদের কাছে অর্থ খুব সহজেই আইডলে পরিণত হতে পারে যার পূজা তারা করে এবং যেটা নিয়ে তাদের খুবই চিন্তা- হতাশা। তাহলে অর্থ, বাইরের বেশ ভূষা, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি এখন তাদের আইডলে পরিণত হয়েছে। একসময় মানুষজন কান্না করত। কারণ, তারা হজ্ব করতে পারেনি। আর এখন মানুষজন কান্নাকাটি করে। কারণ, তার কাছে আইফোন সিক্স নেই। অর্থাত্ তারা একটি আধ্যাত্মিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের নির্দিষ্ট কোনো ভিডিও গেমস নেই। পিএস আছে কিন্তু পিএস4 নেই। বাচ্চারা এগুলোর জন্য অঝোরে কান্না করে। কি করেছি আমরা? আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য আইডল তৈরি করেছি। অথচ এরা একদম নিষ্পাপ ছিল। আপনি ওদের সামনে যা দিবেন; সে ওটাতেই মগ্ন হয়ে যাবে। এরপর আপনি তাদের অফ সেশনের জন্য দোষ দিতে পারেন না। আমি বলছি না যে আপনি তাদেরকে এগুলো দিবেন না। আমার বাচ্চারাও গেমস খেলে। আমি নিজেও ওদের সাথে খেলি। কিন্তু এখানে একটা ভারসাম্য বজায় রাখতেই হবে। আপনার কাজ শুধু আপনার সন্তানদেরকে সব বিলাসিতার জিনিস সরবরাহ করা নয়। কারণ, তখন এই জিনিস গুলোই তাদের আইডলে পরিণত হয়ে যায়। তখন তারা শুধু এগুলোরই পূজা করে থাকে। অর্থাত্ তাদের পুরো জীবনটাই শুধু এগুলোময় হয়ে যায়। কতবার যে আমি তরুণ মুসলিম ছেলে-মেয়েদের কাছে এমন কথা বলতে শুনেছি যে, আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি না। আমি সারা দুনিয়ার কথা বলছি না। আমি শুধু আমাদের এই অঞ্চলের কথাই বলছি। শুধু এখানেই আমি বলতে শুনেছি, আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি না। আমাকে একা থাকতে দাও। ভিডিও গেম খেলতে চাই, একা থাকতে দাও। অর্থাত্ এই দুটি জিনিস কিন্তু আলাদা কোনো ব্যাপার নয়। সেখানে একটা অন্যটির আল্লাহর প্রতিস্থাপক হয়ে গেছে। যখন আপনি দিনে ৮ থেকে ১০ ঘন্টা গেমস খেলছেন।
অথচ আমরা ভাবছি, আমরা খাঁটি মুসলিম। কেননা, আমরা অন্তত জুমা তো আদায় করি, অন্তত ঈদ তো পালন করি। ঈদে কিছু ভালো খাবার দাবার বানায়। তাই আমরা ভাবি আমরা ঠিক আছি।অথচ আপনি যদি আল্লাহ্ এবং আপনার রসুলের(স:) অনুসরণ করেন, তবে কোন কাজই আপনার বৃথা যাবে না। আল্লাহ্ আপনার কোনো আমল নষ্ট করবেন না। শেষ যে উপদেশটা সবার উদ্দেশ্যে দিতে চাই সেটা হলো, আমাদের সন্তানদের ঈমান এবং তাদের জন্য আল্লাহর হেদায়েত আমাদের হাতে নেই। না, আমাদের হাতে একদমই নেই। আল্লাহ্ তাকেই হেদায়েত দেন যাকে তাঁর ইচ্ছা হয়। কিন্তু তাদের জন্য আপনি সর্বোত্কৃষ্ট পরিবেশ দিতে পারেন। আপনি আপনার পক্ষে যতটুকু সম্ভব সেটা করতে পারেন। তা সত্তেও দিন শেষে আমাদের সন্তানরা তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত তারা নিজেরাই নেবে। রাসুল (স:) এমনকি ফাতিমার দায়িত্বও নেননি। না উনি নেননি। আল্লাহ্ প্রতি তাকওয়া তোমার নিজেরই থাকতে হবে। ভয়ও নিজেরই থাকতে হবে। ফাতেমা (র) এর উদ্দেশ্যে রাসুল(স:) বলেন, আল্লাহর সামনে আমি তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারব না। চিন্তা করুন, রাসুল (স:) উনার নিজের মেয়েকে বলছেন, তুমি একা। তোমাকে একাই আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। একা । একদম একা। আমাদের সন্তানদের একা দাঁড়ানোর জন্য তৈরি করতে হবে। এজন্য আমাদেরকে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। আর বাকিটা আল্লাহর হাতে আর তাদের হাতে। কিন্তু আমরা যেন বলতে সমর্থ হই যে, আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করেছি। আমার কথা হচ্ছে, আমরা কিন্তু আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি না। আমি আবারো বলছি, হেদায়েত জিনিসটা আমাদের হাতে নেই। তারা কি রকম হবে শেষ পর্যন্ত, তা তাদেরই হাতে। কিন্তু আমাদের জন্য পিছনে ফিরে এটা বলতেন না হয় যে, আমরা সঠিক সুযোগটি দেইনি। বাস্তব জীবনে আমরা কিভাবে এই কাজটা শুরু করতে পারি। কিভাবে আপনি ইসলামকে আপনার পরিবারের সদস্যদের হৃদয়ে পৌঁছাবেন? আপনার নিজের অন্তরে এবং আপনার পরিবারের সদস্যদের অন্তরে? আমাদেরকে আসলে যেটা করতে হবে সেটা হলো, এই দীন সম্পর্কে আমাদের কথা বলতে হবে, আমাদেরকে আলোচনা করতে হবে আল্লাহকে নিয়ে। আমরা কেন মুসলিম তা নিয়ে, কুরআনের অর্থ নিয়ে, কেন এই দিন একদম সঠিক- তা নিয়ে আমাদের কথা বলতে হবে। কেন আমাদের এই দিন এত সুন্দর তা নিয়ে। আপনি জানেন, আপনার সন্তান স্কুলে যায়। তাদের ক্রিশ্চিয়ান বন্ধু আছে। তাদের ইয়াহুদী, হিন্দু, বৌদ্ধ বন্ধু আছে। তাদের এতসব নন মুসলিম বন্ধু আছে এবং তারা বাসায় আসে আর জিজ্ঞাসা করে, "বাবা! কেন আমরা ভাবি যে, আমরাই একমাত্র সঠিক ধর্ম? আরও তো কত ধর্ম আছে।" আর আপনি যখন এটা শুনেন আপনি বলেন, "আস্তাগফিরুল্লাহ! তুমি এসব কি বলছ? না না! কোন প্রশ্ন করা যাবে না।" আপনাকে জানতে হবে; কেমন করে এসব ব্যাপারে কথা বলতে হয়। এটাই সুযোগ যে আপনার সন্তানেরা এ ধরনের প্রশ্ন করছে। সেটাই ভালো জিনিস, এটা খারাপ জিনিস নয়। এটা তখনই খারাপ ব্যাপার যখন আপনি সেই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না এবং এড়িয়ে যাচ্ছেন। আপনি যদি না জেনে থাকেন যে, কিভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়? তাহলে বরং আপনি নিজেই পড়াশোনা শুরু করুন। অন্য কেউ এসে তাদেরকে শেখাবে না। পিতা-মাতা ভাবে, না না তাদের নামীদামি স্কুলে দিয়ে দিলেই হয়ে যাবে। না, আপনার সন্তানের কাছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ; যেটা আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কেউ এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। এই সমস্যার সমাধান আপনি বাইরে থেকে আমদানি করে আনতে পারবেন না।এটা আপনার সমস্যা। আপনার নিজেরই নিজেকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। বিশেষত ঐ ধরনের ছোট কমিউনিটির জন্য, যেখানে আপনার চারপাশে শুধু non-muslim থাকে। তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে, আপনি প্রতিনিয়ত প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন। আপনি সব ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন সব সময়। কারণ আপনি মুসলিম । এর কোন থামাথামি নেই। কোন শেষ নেই। আপনি কিভাবে সেই প্রশ্নের জবাব দেবেন, যে জবাব আপনি নিজেই জানেন না। আল্লাহর কিতাব এতই শক্তিশালী, এই দীন এতই শক্তিশালী যে, আপনি শুধু সেই প্রশ্নের জবাবই শিখবেন না; ততক্ষনাত প্রশ্ন করাও শিখবেন। আপনাকে কেউ প্রশ্ন করবে বিষয়টি শুধু এমন হবে না; বরং আপনিও উল্টো প্রশ্ন করবেন। আপনি প্রশ্ন করবেন তাহলে আমরা যেটা করি সেটা অর্থপূর্ণ নয়? তাহলে এটা কি? তাহলে ওটা কি। এগুলো তোমাদের কাছে কি অর্থ বহন করে? আমরা নিজেরা সব সময় ডিফেন্সিভ থাকি; কারণ আমরা এটা প্রমাণ করি যে, প্রকৃতপক্ষে আমাদের যে ঈমানটা থাকা উচিত সেটা আমাদের নেই। একবার যদি আপনি ঈমানের প্রকৃত সৌন্দর্য এবং স্বাদ অনুভব করতে পারেন; আপনি তখন অন্যদের সাথে সেটা শেয়ার করতে চাইবেন। আমরা আমাদের সন্তান এবং নিজেদের এইরকম প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমাদের দীনের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করতে চাই। আমি এখানে বদলী হয়ে এলাম এবং তখন থেকেই আমি ভাবছিলাম এটা কেমন জায়গা কোথাও কিছু নেই; শুধু খালি জায়গা পড়ে আছে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। অথচ এর মাঝেও আল্লাহ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে আমি বা আপনারা এখানে থাকবেন। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আলা লোক এখানে থাকবে। জানেন এর মানে কি? এই পুরা এলাকায় যদি ইসলাম সম্পর্কে জানা লোক কেউ না থাকে; তাহলে সেটার দায় আপনার এবং আপনার সন্তানদের। তাই তিনি আপনার এবং আপনার সন্তানদের এই জায়গায় নির্দিষ্ট কোন কারণেই পাঠিয়েছেন। আপনি চাকরি করেন, আপনাকে অন্য কোন জায়গা তিনি দিতে পারতেন। অর্থ দেওয়া আল্লাহর জন্য অত্যন্ত সহজ। এটা তাঁর কাছে কোনো সমস্যাই নয়। আল্লাহ কেবল মানুষকে একটা জায়গায় সেটিং করেন শুধুমাত্র কোন নির্দিষ্ট কারণেই। আল্লাহ মানুষকে সেটিং করেন অবশ্যই নির্দিষ্ট কোনো কারণে। আপনি এখানে আছেন। কারণ দুনিয়ার এই জায়গাটাতেই আপনার থাকার দরকার আছে। এটা অন্য কোথা থেকে ডাউনলোড হবে না। এটা আপনার থেকে আসবে। এটা আপনার থেকেই আসবে। সন্তান থেকে আসবে। তাই আমাদেরকে এই দায়িত্ব নিতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে কাজ দিয়েছে, আমাদেরকে স্বাস্থ্য দিয়েছেন, আমাদের কে সুযোগ দিয়েছেন, আমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন, আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। এখন সময় হল, আপনার আল্লাহর দ্বীনকে কিছু দেবার। প্রথমে নিজের পরিবারকে শক্ত করুন এবং এরপর এমন ব্যক্তি হন, যে নিজের আশপাশের লোকদের কাছে তা শেয়ার করে। আমি দোয়া করি যে, আমরা সবাই এ বিষয়ের তাগিদ এবং গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের দায়িত্ব অনুভব করি। আমরা কেউ যেন এমন ব্যক্তিত্বে পরিণত না হয়; তাদের কাছে ঈমান একটা ক্যাজুয়াল ব্যাপারে পরিণত হয়। যাদেরকে বলতে হয়, তোমার শরীরে ইসলাম আছে। অথচ এখনও ঈমানের স্বাদ অনুভব করো নি। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি যে, উনি আমাদের সবাইকে সেই সুযোগ দেয়; যেন আমরা সকলেই ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করি। তিনি আমাদের সেই ঈমান দিক এবং আমাদের সন্তানদের অন্তরে সে ঈমান দিক এবং আমাদেরকে দায়িত্ববান অভিভাবক এবং কমিউনিটির দায়িত্ববান নেতায় পরিণত করুক। আমি দুয়া করি আল্লাহ আমাদের মুসলিমদের অন্তরকে একত্রিত করুক যেন তা শুধু শুক্রবার জুমাতেই একত্রিত না হয়। তারা যেন তাদের বাসাতেও মিলিত হয় । আমি চাই তাদের প্রত্যেকটি জমায়েত আল্লাহর নিকটবর্তী করুক। আল্লাহ থেকে দূরে নয়। আমি দোয়া করি যে, মুসলিমদের ভাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি হোক। তাদের দীন বোঝাকে শক্ত করুক। তাদের পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি হোক। বাচ্চাদের সকল অভিভাবক নিজেরা বন্ধুত্ব করবে এবং তাদের বাচ্চারা নিজেরা একে অপরের সাথে বন্ধু হবে। এভাবে আমাদের সন্তানরাও অমুসলিম বন্ধুদের মাঝে বড় হবে এবং যাদের তারা বিশ্বাসও করবে। এটা আমাদের বাচ্চাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি এইসব জিনিসগুলোর ব্যাপারে সকলের জন্য দোয়া করি, আল্লাহ, এদের প্রত্যেককে রক্ষা করুন এবং এই জনপদের প্রত্যেককেই রিযিকে বারাকা দান করুন। আমিন!
Comments
Post a Comment