স্বার্থপর বন্ধুঃ পর্ব-১
পর্ব-1:স্বার্থপর বন্ধু
মোঃ এনামুল হক
যে ছেলেটা এখান থেকে হেসে চলে গেল না, রাহাত, ও ছিল একসময় মতিনের চোখের মনি। ওকে খুবই ভাল জানতো মতিন। কারণ সে ভাবতো, অসহায় ছেলেটা। মা থেকেও নেই। সত্ মায়ের অসত্ শাসনে বড়ই অভ্যস্ত ও। আর সেই শাসন যে কত কষ্টের তা ওর মত ভুক্তভোগীরাই ভালো করে বুঝতে পারে। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। তবে যাই হোক, রাহাতের মুখের দিকে চেয়েই মতিন ওর কষ্টগুলো হৃদয়ের গহীন থেকে উপলব্ধি করতে পারতো। তাই রাহাতও মাঝেমধ্যে এসে তার কষ্টের কথাগুলো বাল্যবন্ধু মতিনকে খুলে বলতো। ওর সেই দরদ মাখা আবেগী কথাগুলো শুনে মতিনের মনটা খুবই খারাপ হতো। তাই ও ভাবতো, রাহাত যেন লেখাপড়াটা বাদ না দেয়। কেননা ও যেন পড়াশোনাটা শিখে মানুষের মত মানুষ হতে পারে। আর সেজন্য যা যা সহযোগিতা করা প্রয়োজন মতিন সেটা করবে। মাঝে মাঝে ও মতিনকে এসে বলতো, ভাইয়া, আজকে এই পড়াটা না.. ! আমি নিজে নিজে বুঝতে পারছি না। তুই যদি একটু বুঝিয়ে দিতিস। নয়তো আমি পেরে উঠছি নাযে, ভাইয়া! এজন্য মতিন একান্তভাবে ওর পেছনে কিছুটা সময় নিয়মিতভাবেই ব্যয় করতো। একটু এক্সট্রা কেয়ার নিতো। এক ক্লাস উপরে থাকায় পড়া বোঝানোর কাজটা মতিনের জন্য সহজই হতো। ওর অসহায়ত্বের জন্য ওর প্রতি মতিনের একটু বেশিই মায়া জন্মে গেছিলো। এটা দেখে রাহাতের সমবয়সী বন্ধুরা আবার মনে মনে বেশ ঈর্ষা করত। এগুলো উপেক্ষা করেও মতিন তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করার জন্য তত্পর থাকতো। অসহায় রাহাতও বন্ধুর প্রতি অনেক মায়ার অনুভূতি ব্যক্ত করত। শত রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাহাত যখন বিকালে খেলতে যাবার মনস্ত করত, তখন মতিনের ঘাড়ে হাত রেখে পরম নিশ্চিন্তে পশ্চিমের ধানের মাঠে ফুটবল খেলা করতে চলে যেতো। আবার নদীতে গোসলের সময়ও মতিনের সাথে করে নদীর মাঝে ঝপাত করে ঝাঁপ দিতো। এরপর দুজন কলার ভেলায় চড়ে নদীর বুকে আস্ফলন করতে করতে এদিক-ওদিক দিকবিদিক সাঁতার কেটে চোখ লাল করে বাড়ি ফিরতো। তারপর মতিনের সাথে সময়টা ভালো কাটলেও রাহাত বাড়ি এসে আবার সেই পান্তা ভাত আর সৎ মায়ের তিক্ত বকুনি একসাথেই খেয়ে নিত। এভাবে যখন ওরা স্কুল শেষে গরু অথবা ছাগল মাঠে চরাতে যেতো, তখন পরম কষ্টে দুজন মিলে সে ছাগল-গরু চরিয়ে ডুবন্ত বেলায় বাড়ি ফিরতো। ফলে দুজন মিলে তাদের মনের কথাগুলো শেয়ার করার মত যথেষ্ট সুযোগ পেতো। অনেক সময় কষ্টের কথাগুলো বলতে গিয়ে রাহাত অবলীলায় তার চোখের পানি ঝরাতো। এভাবেই চলছিল ওদের দিনগুলো।
আর এর মধ্যেই রাহাত কোন রকম প্রাইমারি পাস করে ফেলল। তারপর মাধ্যমিক এবং অবশেষে অনার্সেও ভর্তি হল ও। এক্ষেত্রে মতিনের মানসিক সাপোর্টের সাথে সাথে ওর পিতার নিরব আর্থিক সাপোর্টও ছিল অতুলনীয়।
একবার ও বাড়িতে রাগ করে কাউকে না জানিয়ে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকায় যেয়ে তিন দিন থাকে। পথে পথে বেড়িয়ে ও ওর সার্টিফিকেট খোয়ায়। এরপর কোনো এক বৃষ্টিভেজা রাতে সে তার নথিপত্রসহ সমস্ত কিছু হারিয়ে বিধ্বস্ত চিত্তে বাড়ি ফিরে। তারপর বন্ধুদের সহায়তায় জিডি করে,পেপার কাটিং করে সে তার সার্টিফিকেট গুলো আবার উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এভাবে অসংখ্যবার পরিবারের সাথে রাগ অনুরাগের বশবর্তী হয়ে ও বাড়ি থেকে হারিয়ে যায়। কোথায় যে চলে যায় আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অভিমান অনুযোগ একটু স্তিমিত হলেই ও আবার নিজের ইচ্ছায় বাড়ি ফিরে আসে। ওদের গ্রাম থেকে জেলা শহর প্রায় আট কিলোমিটার দূরে। এমনও রেকর্ড আছে, কি একটা বিষয়ে যেন রাগের কারণে ও একবার প্রাইভেট পড়ার জন্য আট কিলোমিটার পথ হেঁটে শহরে চলে যায়। কতবড় ঘাড়তেড়া হলে মানুষ এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা এই ধরনের কাজকর্ম স্বচক্ষে না দেখলে বা তার সাহচার্যে না আসলে বোঝা বড় দায় হয়ে পড়ে। একবার মথুয়াপুর (সেটাও প্রায় দশ/এগার কিলোমিটার দূরে) ওয়াজ শুনতে গিয়েছিলো ওরা গ্রামের অনেকগুলো ফ্রেন্ড মিলে। সেখান থেকেও কি যেন একটা বিষয়ে রাগারাগি, অভিযোগের পারদে বুঁদ হয়ে ও একা প্রচ্ছন্ন অন্ধকারের এত পথ হেঁটে বাড়ি চলে আসতে একটুও দ্বিধা করে না। এত বিশ্রী অভিমান আর এত অচ্ছুত বদমেজাজী ভাব ও নিয়মিত চর্চা করতো যেটা ওর বন্ধুদের কারোরই পছন্দ হতো না। কিন্তু ওর নিজের মতামত, নিজের জেদ, নিজের আবেগ, নিজের আত্মকেন্দ্রিকতা প্রকাশের জন্য এইগুলো নিয়মিত বা অনবরত ভাবেই করে যেত। বন্ধুরা মিলে এটা শোধরানোর অনেক চেষ্টা করতো এবং নানাভাবে বুঝাতো; কিন্তু ও কিছুতেই শোধরানোর পাত্র ছিল না। ও ভাবতো ও যেটা করছে সেটাই ঠিক করছে। অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর রাহাত চলে আসলো শহরের এক ম্যাচে। ম্যাচে থেকে ও টিউশনি করতো আর নিজের খরচটা চালাতো। তাই ওকে মতিনসহ বন্ধুরা সবাই বোঝাতো, দেখ এত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখছিস, তা ভুল করেও যেন কখনো বিপথে পা বাড়াস না। এভাবে চলছিল ভালোই। কিন্তু সে যখন একটু বোঝার মত হল, তখন নিজের মত করে পথ চলা শুরু করলো। অর্থাত্ মতিনসহ ওর অন্যান্য বন্ধুদের তেমন একটা ধারই ধারতো না ও। মতিন সেটা বুঝতো এবং মনে মনে ভাবতো, রাহাত হয়ত ভিতরে ভিতরে এমন কিছু করতে চাচ্ছে যেটা তার কাছে কেন জানি তা লুকাতে চাচ্ছে ও। কারণ মতিনকে বললে হয়ত তার সেই কাজটা আর সিদ্ধ নাও হতে পারে। এই করণেই বোধ হয়, মতিনের কাছ থেকে ও একটু লুকিয়ে চলার চেষ্টা করছে আরকি। সেটা বুঝতে পেরেও মতিন তাকে হাজার বারণ করেও সেই বিপথে যাওয়া হতে রোধ করতে পারে নাই। ফলে এখন সে ওই বন্ধুদেরকেই বেছে নিয়েছে যে তাকে ওর ঐ কাঙ্ক্ষিত পথে উতসাহ দেয়, সাপোর্ট করে এবং তার মতন হয়ে চলে।
রাহাত একবার এক কোচিংয়ে গেল, ক্লাস নেবে বলে। মতিন বাই দা বাই শুনতে পেলো, সেখানে নাকি ওর এক ম্যাডাম কলিগ আছে। ও নাকি ঐ ম্যাডামের প্রেমে এখন ভীষণ হাবুডুবু খাচ্ছে। জানতে পেরে মতিন ওকে ডেকে বলল, ক্যারিয়ারের এখনো অনেক বাকি রাহাত। এখন তুই এই সমস্ত কাজ ছেড়ে দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দে। কে শোনে কার কথা। ও ওর কলেজের জানাশোনা বন্ধুদের সাথে অন্য একটা ম্যাচে থাকতো। পরে মতিন ওর বন্ধুদের কাছে শুনে এবং ওর মতি গতি দেখে, একটু শোধরানোর জন্য এবং উচ্ছন্নে যাওয়া রোধ করতে ওকে তার নিজের ম্যাচে নিয়ে আসলো, যাতে করে এখান থেকে অন্তত ও যেন নেতিবাচক দিকগুলো থেকে দূরে থাকতে পারে। কিন্তু ওকে কাছে এনে মতিন পড়ে আরেক বিপদে। কারণ একেক ঠুনকো বিষয় নিয়ে ও অন্যান্য ম্যাচমেটদের সাথে নানান বিবাদে জড়িয়ে যায়। একদিন পরিষ্কার জায়গায় ময়লা জুতা রাখা নিয়ে ওর পাশের রুমের এক জুনিয়রের সাথে ভীষণ কথা কাটাকাটি হয়। এর জের ধরে রাহাত পরেরদিন ওর পরিচিত কিছু বখাটে ছেলে নিয়ে এসে ঐ ম্যাচমেটকে ভীষণ প্রহার করে। আর এ কাজটুকুর কিছু পারিশ্রমিক পাবার আশায় পরেরদিন রাহাতের এক নেশাখোর বড়ভাই ওকে ফোনের মাধ্যমে জানায়। তখন রাহাত বড় ভাইকে মতিনের ফোন নম্বরটা দিয়ে ম্যাচে পাঠিয়ে দেয়। মতিন প্রস্তুত হয়ে টিউশনির উদ্দেশ্যে বেরোনোর জন্য মাত্রই গেটের বাইরে এসেছে। আর তত্ক্ষণাত্ ওর মোবাইলটা বেজে উঠল। সামনেই রিংটন বাজা দেখে মুখ ভর্তি সিগারেটের ধুয়ার মাঝে মার্বেলের মতো লাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঐ বড় ভাইটা মতিনের দিকে অগ্রসর হলো। মতিনের ফোন রিসিভ করার আগেই কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, " আপনি রাহাতের পরিচিত?" "হ্যাঁ, কিন্তু কেন?"- মতিন উত্তর দিলো। দূরে থাকায় ও আপনার নম্বরটা দিল আর যোগাযোগ করে পাঁচ শ' টাকা নিতে বলল।ও পরে এসে আপনাকে টাকাটা দিয়ে দিবে। মতিন সঙ্গে সঙ্গে রাহাতকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানতে চাইলো। ও বললো, "নাম্বারটা আমিই দিয়েছি কিন্তু তুই টাকা দিসনে।" মতিন রাগের স্বরেই বলল, "লোকটা ম্যাচের সামনে সিনক্রেট করছে। তুই আমার নাম্বার তাকে দিয়েছিস, আবার এখন বলছিস টাকা দিসনে।" বলেই মতিন ফোনটা কেটে দিল। মতিনের পকেটে মাত্র দুই শো টাকা ছিল। চাকরির পরিক্ষা দিতে রাত্রে ঢাকায় যাবে বলে বাসের টিকিট কাটার জন্য সে অনেক কষ্টে টাকাটা বাঁচিয়ে রেখেছে। নানান হুমকি ধামকির মুখে অনেক কথা খরচ করেও মতিন লোকটার হাত এড়াতে পারলো না। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই যখন সে তার পকেটের দুই শ' টাকা বের করে দিলো, তবেই লোকটা ওখান থেকে বিদায় নিল। যাইহোক, আরেকদিন পহেলা বৈশাখের বিকেলবেলা । গাঁয়ের বন্ধুরা তাকে বনভোজনের উদ্দেশ্যে ফোন করে গ্রামে যেতে বলে। অথচ একই ম্যাচে থাকা মতিনকে না বলেই ও বন্ধুদের ডাকে সাড়া দিয়ে গ্রামে চলে যায়। টিউশনি বন্ধ থাকায় মতিনও সেদিন গ্রামে চলে যায়। যেয়ে দেখে রাহাত বহাল তবিয়তে পিকনিকের মধ্যমণি হয়ে বসে আছে। এটা দেখে মতিনের গায়ের ভিতর দুপদুপ করে জ্বলছিল। যাইহোক পরিস্থিতিটা নিজের মনের মধ্যেই সামলে রেখে মতিন পিকনিকের অঘোষিত মেম্বার হিসেবেও এক পিচ মাংস খেয়েই ওখান থেকে প্রস্থান করলো। মনে কষ্ট লাগে এমন কাজগুলো না করতে মতিন রাহাতকে অনেক বোঝায়।কিন্তু বিধিবাম, কামার যা গড়ে তা মনে মনেই গড়ে।
একদিন রাতে দেখা গেল ও হন্তদন্ত হয়ে ম্যাচে ফিরে আসলো। ম্যাচের ফিরে ও মতিনকে বলছে, ভাইয়া, একটা কাজ করে ফেলেছি যে। এখন কি করবো আমি বুঝতে পারছি না। মতিন বলল, কি হয়েছে বল? ও বলল, একটা মেয়ে আমার সাথে চলে আসতে চাইছিল। কিন্তু মাস্তান টাইপের কিছু পুলাপানের ধাওয়া খেয়ে আমি মেয়েটাকে সাইকেল থেকে নামিয়ে একটা গলির ধারে একা ফেলে রেখে চলে এসেছি। আমাকে ভালোবেসে মেয়েটা তার মায়ের সাথে পর্যন্ত কথা কাটাকাটি করেছে। এমনকি ও আর বাড়ি ফিরে যাবে না বলে ওর মায়ের সাথে চ্যালেঞ্জ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। এখন ফোনে বলছে, মেয়েটি নাকি মিলের পাশে দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। মেয়েটি এমনও বলে রেখেছে যে, আমি যদি সেখানে না যায় তাহলে ও নাকি আত্মহত্যা করবে। এই মুহূর্তে আমি কি করবো ভাইয়া? মতিন বলল, "ওই মেয়েটা আবেগে পড়ে এসেছে এবং আবেগ শেষ হয়ে গেলে ও নিশ্চয় আবার বাড়িতেই ফিরে যাবে।" "কিন্তু ভাইয়া, অসহায় একটা মেয়েকে সাইকেল থেকে নামিয়ে রাস্তার পাশে রেখে এসেছি। এটা কাপুরুষের মতন কাজ হবে, যদি না আমি সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে আনি।" রাহাত তার অকাট্য যুক্তি উপস্থাপন করার চেষ্টা করলো। মতিন আবার বোঝালো, "তুই যেহেতু ধাওয়া খেয়ে অন্তত ম্যাচে চলে আসতে পেরেছিস, এখন আর তোর মোবাইল খোলা রাখার দরকার নেই। চুপচাপ বসে থাক। তোর আর ওদিক নিয়ে ভাবার কোনো দরকারই নেই। কারণ ফিরে গেলেই তুই নিশ্চিত বিপদে পড়বি। কারণ, আমার মনে ডেকে কচ্ছে, এইটা একটা ওই মেয়ের পাতা কোনো ফাঁদও হতে পারে। তাই তুই ভুল করেও কখনো ও ফাঁদে পা দিস না।" এভাবে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ওকে ওর রুমে শুইয়ে রেখে মতিন তার রুমে চলে গেল। মতিন তার রুমে এসে কম্পিউটারের কিবোর্ড টিপছে আর ওর কথাটা বারংবার ভাবছে। কম্পিউটারে মতিন তখন কি যেন একটা আর্টিকেল লিখছিল। এভাবে লিখতে লিখতে তাও প্রায় আধা ঘন্টা হয়ে গেল। এর ফাঁকে রাহাতের কোন সাড়াশব্দ নেই। চুপচাপ। হঠাৎ মতিনের কেমন জানি মনে হলো, যাই ওদিক গিয়ে একটু দেখে আসি তো কি হলো। যেয়ে দেখে সত্যিই রাহাতের ঘরটা শুনশান অন্ধকার। ওতো ঘরে নেই-ই, বরং ওর কোন কায়া-ছায়াও ওখানে পাওয়া যাচ্ছে না। মোবাইলও বন্ধ। কোথায় যে গিয়েছে ও, তারও কোনো প্রকার ট্রেসও করতে পারছে না মতিন। মতিনতো পড়ে গেলো মহা টেনশনে। এমনকি ওয়ালে হেলান দেওয়া রাহাতের সেই সাইকেলটাও আর দেখা যাচ্ছে না। ফলে সে উঁকিঝুঁকি মেরে এ গলি ও গলিতে একটু নিজের মত করে টুয়িয়ে টুয়িয়ে খোঁজার চেষ্টা করছে যে, কোথায় গেলো ছেলেটা? কিন্তু কোথাও তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে না। মতিন চিন্তা করলো, ভালো করে খোঁজার জন্য এত রাতে মনে হয়, এভাবে একা বেরোনো ঠিক হবে না। তাই পাশের রুমের আবিদকে সাথে নিয়ে বেরনোই উত্তম। অন্যদের মত মুটকা আবিদও ঘুম যাচ্ছিল অঘোরে।
রাত তখন প্রায় একটা দেড়টা বাজে। এত রাতে সবাই ঘুমিয়ে বিভোর হয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তারপরও ওরা সব পড়াশোনা করে ক্লান্ত হয়ে এইমাত্রই ঘুমিয়েছে। তাই এখন ডাকলে কেমন হবে, এমন একটা ইতস্ততঃও মতিনের কল্পনায় ঢেউ খেলে গেলো। তারপরও যেহেতু ম্যাচের একটা ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, আবার তাতে সে মতিনের বাড়ির পাশের অতি কাছের মানুষ। আর এমন একটা মানুষ ম্যাচ থেকে হারিয়ে যাবে এটা কোনোভাবেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না মতিন। রাহাতের ফোনে অনবরত কল ঢোকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে মতিন, কিন্তু ওপাশ থেকে "এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না" বলে বারবার দু:খ প্রকাশ করছে এক মহিলা। রিং ঢোকানো সম্ভব হচ্ছে না তো হচ্ছেই না। এরপর রাখঢাক না করেই আবিদকে ডাকল মতিন। বলল, রাহাতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চলো তো, কোথায় আছে একটু খুঁজে আসি। তারপর আবিদ আর মতিন একসাথে গোরস্থান রোডের দিকে প্রায় আধা কিলোমিটার হেঁটে গেলো। কিন্তু রাহাতের কোন খোঁজ পেলো না ওরা। নিষ্ফল হয়ে ওরা দুজন রুমে ফিরে আসলো। ফিরে এসে ওরা অনেক বিচার বিশ্লেষণ করে অবশেষে চিন্তিত মগজে যার যার রুমে চলে গেলো। এমন সময় মতিন দেখতে পেলো, চলা হাতে একটা অগোছালো চ্যাকনা ছেলে কর্কশ আওয়াজে ধেয়ে চলে আসছে তাদের ম্যাচের দিকে। মতিনের রুমের জানালা খোলাই ছিল। তাই ওর জানালার পাশেই এসে দাঁড়ালো ঐ নিশাচর মাতাল গোছের ছেলেটা। জঞ্জালময় মাস্তানী চুলওয়ালা বখাটে ছেলেটার মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে এবং মতিনের দিকে চলা দিয়ে শাসাচ্ছে আর বলছে, "এখানে তোরা কি বেশ্যালয় খুলে নিইছিস যে, যখন যা মনে চাচ্চে তাই কচ্চিস? মদ,গাজা,মেয়ে-মানষ সব সব খ্যাস তোরা? দেহ ব্যবসা লাগাইছিস? দেহ ব্যবসা?" চিল্লানি শুনে মতিন তখন এগিয়ে গেলো জানালার পাশে। বললো, "কেন ভাই কি হয়েছে? এত রাতে আপনি একটা ম্যাচের সামনে এসে এতো চিল্লাচ্ছেনই বা কেন?" মতিনের কথা শুনে ছেলেটা আরো বেশি ক্ষেপে গেল। "এই চিল্লাচ্ছি মানে! রাতদুপুরে একটা মেয়েকে নিয়ে এসে তোরা সবাই রেপ করার চেষ্টা করছিস, আবার লম্বা গলাই কথা কচ্চিস!" মতিন ওর কথা শুনে তো একেবারে থ খেয়ে গেলো। ও আবার বলল, "এই ম্যাচে তোরা কয়জন আছিস? প্রত্যেককে জরিমানা দিতে হবে। বিশ হাজার টাকা নিয়ে মোড়ের দিকে আয়।" মতিন কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে বলল, "ভাইজান, চেঁচামেচি করে তো সমস্যার সমাধান হবে না। কি হয়েছে আগে খুলে বলেন, তারপরেই না বিষয়টা সমাধান হবে।" ও বলল, "কি আর হবে? এই ম্যাচে রাহাত নামে একটা ছেলে থাকে না? সে তো একটা মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। আমরা সবাই টের পেয়ে ওদের আটকে রেখেছি। এখন তো রাহাতকে হয় মেয়েটাকে বিয়ে করতে হবে নতুবা পুলিশের ডান্ডা ওর পিঠে পড়বে। তার আগে দাঁড়া, আমার এইটা ওর পিঠে ভেঙে আসি। তোরা এখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে জানা কি করবি" - এরকম ঘতঘত করতে করতে মাস্তান টাইপের ছেলেটা চলা হাতেই মোড়ের দিকে চলে গেল।
ওর কথা শুনে তো মতিনরা খুবই ঘাবড়ে গেল এবং টেনশনে পড়ে গেলো, এখন তারা কি করবে! মতিন কিন্তু এই ঘটনা ঘটার আগে রাহাতকে বারংবার সাবধান করেছিল , "তুই যা করেছিস করেছিস, এটা এখানেই অন্তত ক্ষান্ত দে। মেয়েটির ফাঁদে তুই পা দিসনে রাহাত। ও যেখানে থাকে থাকুক। তুই ম্যাচে থাক। ছলনাময়ী মেয়েটা একসময় ঠিকই বাড়ি চলে যাবে। আর আমার কথা যদি তুই না শুনিস, তাহলে অবশ্যই মহাবিপদে পড়বি।" মতিন আরও যোগ করলো, "বিষয়টি যেহেতু পাড়ার ছেলেদের কাছে জানাজানি হয়ে গিয়েছে, তাই এখন যদি তুই ওকে সিনেমার নায়কের মতো আনতে যাস, তাহলে রাত দুপুরে একটা মস্ত বড় ঝামেলা হয়ে যাবে।" আর সেই ঝামেলাটাই এখন মতিনের কাঁধে এসে সওয়ার হলো। রাত দুপুরে এখন এই ঝামেলা কে পোহাবে? তাই মনে মনে বিরক্ত হয়ে মতিন নিজের সাথে বিড়বিড় করে আরো বলতে থাকে, "প্রায় সব ক্ষেত্রে ও এরকম একটা আধকেচড়া ঘটনা ঘটিয়েই খালাস, এরপর ছ্যাচড়া চোরের মত ম্যার খাওয়া ছাড়া ওর আর কোনো কাজ থাকে না। আশেপাশের মানুষের হয় তখন যত জ্বালা।"
যাইহোক, ওর এমন অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে ঐ রাতে মতিন যে কি বিচলিত অবস্থায় পড়লো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এককথায়, একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো মতিন। তখন ও যে কি করবে তা ভেবে কুল কিনারাই পাচ্ছিলো না । তারপর হঠাত্ ওর মনে হল, উপরে তো তামিম ভাই থাকে। বাড়িওয়ালার ছেলে। ওর কাছে গেলে হয়তো একটা সমাধান হতে পারে। তাই তামিম ভায়ের কাছে গিয়ে মতিন বলল, "তামিম ভাই, আপনি তো স্থানীয়, এলাকায় আপনার পরিচিত আছে। তাই আপনি যদি একটু আমাদের সাথে আসতেন, খুব ভালো হতো! ওই ছেলেটা বিপদে পড়েছে। এই বিপদের রাতে যদি আমরা কেউ ওখানে না যাই, তাহলে ওকে ঐ বখাটে ছেলেগুলো প্রচুর মারধর করবে অথবা একটা কিছু করে ফেলবে। চলেন না তামিম ভাই, আপনার রিকোয়েস্টে যদি কিছু রেহায় পাওয়া যায়।" বোঝাই যাচ্ছে, এ পরিস্থিতিতে তামিম ভাই খুব একটা ভালো ফিল করছে না। আর তাই সে একটু চুপ থাকার পর মুখ খুললো, "এত রাত্রে আমি কোথায় যাব?" তারপরেও মতিন তামিম ভাইকে অনেক বার রিকুয়েস্ট করে, অনেকটা হাতে-পায় পড়ে রাজি করিয়ে সাথে নিয়ে গেলো মোড়ের দিকে।
এরপর তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে অর্ধপ্রস্তুত এক ফার্মেসির দ্বিতীয় তলায় রাহাতকে ধরে হাত-পা বেঁধে রেখেছে ওরা। পুরানো গামছার ন্যাকড়া দিয়ে চোখও বাঁধা আছে আস্টেপিস্টি। একটা হাঁটুছেঁড়া জিন্স পরিহিত ছেলের হাতে আদলা ইটের দলা। ঐটা দিয়েই ও মাঝেমধ্যে আঘাত করছে রাহাতের মুখে, আবার কখনো হাতে, কখনো পায়ে। ম্যাচ থেকে শাশিয়ে আসা ঐ ছেলেটার হাত থেকে এখনো সেই চলাটা নামেনি। মাঝেমধ্যে সেও এটা বেমালুম ব্যবহার করছে রাহাতের হাতে অথবা পায়ের গিরেতে আঘাত করার কাজে। কেউবা আবার কাছে গিয়ে সাঁটিয়ে মারছে চড়। এক কথায়, যে যেমন ভাবে পাচ্ছে, তেমন ভাবে নির্যাতনের সব নিষ্ঠুর আয়োজনই সেখানে চলছে।
কিন্তু আশ্চর্য ! এতকিছু শাস্তি নির্যতনের পরও রাহাত অনুভূতিহীন জড়বস্তুর মত মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মতিন ভিতরে ভিতরে নিজের সাথে দাঁত খিটিমিটি করে বলছে, "ওকে দেখলে মাঝেমধ্যে মনে হয় ওর মধ্যে কোন মানুষের আত্মাই নেই। মনে হয়, ও নিশ্চিত কোন পাথরে তৈরি অন্য গ্রহের একটা নিশ্চল অদ্ভুত জীব। বান্দারামকে এত মারা মারছে, এত করে পিটাচ্ছে অথচ তার ভেতরে উচ্চস্বরে কান্নার কোন লক্ষণ বা আভাস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।" এটা দেখে ওর প্রতি মতিনের মনে মনে খুব রাগ হল। আবার পরক্ষণে মায়াও হলো। তাই সহ্য করতে না পেরে মতিন একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে ওই ভাইদের কাছে বলল, "ভাই একজন মানুষকে এভাবে মেরে ফেলে তো সমস্যার সমাধান হয় না। বরং ওর একটা কিছু হয়ে গেলে আপনাদেরই লস। দয়া করে একটু মারা বন্ধ করেন। অসহায় ছেলে। মা থেকেও নেই। সৎ মায়ের কাছে মানুষ। দয়া করে, আপনারা ওর বাঁধন খুলে দেন....প্লিজ। এরপর অন্তত বলেন, এখন এ ব্যাপারে আপনারা কি সমাধান চান? হয় ওকে মেয়েটির সাথে বিয়ে দিয়ে দেন অথবা জরিমানা করে পুলিশে দিয়ে দেন। তারপরও আপনারা অন্তত এত নির্যাতন করেন না।" একথা শুনে একটা ছেলে তো মতিনের দিকে তীরের বেগে ছুটে গেলো। এসে বলে, "কি বলতে চাস, তুই কে? তুইও যদি এ অবস্থা বরণ করতে না চাস তাহলে ওর অভিভাবককে ডাক দে।" তামিম ওদের সবাইকে চেনে বলেই মতিন কথাগুলো এভাবে বলার সাহস করেছিলো। মতিনের কথার সূত্র ধরেই তখন তামিম বলল, "এর যেকোনো একটা সমাধান তো প্রয়োজন। এভাবে তো আর সারারাত মরা পাহারা দেওয়া যায় না।" এ সময় ওদের একজন তামিমকে উদ্দেশ্য করে বলল, "তাহলে তোরা কিভাবে এর সমাধান করবি একটু ডিসিশন নিয়ে জানা।" কথা শেষ না হতেই একজন হুট করে বলল, "বিশ হাজার টাকা লাগবে তাহলে বিষয়টা সমাধান হবে।" তামিম বলল যে, "বিশ হাজার টাকা এখন ওরা কোথায় পাবে? তার চাইতে এখন তোরা ওকে আমার কাছে ছেড়ে দে। সকালবেলা ওর অভিভাবকরা আসুক। তারা টাকা দিয়ে, তারপর ওকে নিয়ে যাক।" একজন বলল, "তাহলে তুই জিম্মাদার হয়ে সমস্যার সমাধান কর।" তখন তামিমের সাথে মতিন আলোচনা করল, কিভাবে কি করা যায়। তানভীর মতিনকে বলল, "এর বাড়ি অভিভাবক আছে না? ওদেরকে ফোন করেন। ফোন করে পরামর্শ করেন,তারা কি বলে সে অনুপাতে কাজ করেন।" মতিন তখন ওই রাত্রে রাহাতের বাড়িতে অর্থাত্ তার আপন ছোট ভাই ফাহাদের কাছে ফোন দিলো।
কিন্তু কেউ ফোনটা ধরছে নাতো ধরছেই না। সাত-আট বার রিং দেয়ার পরে অবশেষে ফাহাদ ঘুমের ঘোরে ফোনটা রিসিভ করল। ফোন রিসিভ করে ও বলে এত রাত্রে আমি ওর জন্য কি করব মতিন ভাই? মতিন বলল, "ফোনটা একটু জামিল ভায়ের কাছে দাও, কথা বলি। জামিল ভাই ফাহাদদের সত্ ভাই হলেও, বাবা মারা যাবার পর থেকে সে লেখা পড়া হতে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই ফাহাত-রাহাতের অভিভাবকত্ব পালন করে আসছে। ফাহাদ দরজা গুতিয়ে গুতিয়ে অবশেষে জামিল ভায়ের কাছে ফোনটা দিতে পারল। জামিল ভাই ঘুমের ঝুলি টানা গলায় একটু বিরক্ত হয়েই বলল, "মতিন, কি হয়েছে বল?" মতিন সমস্যাটা সংক্ষেপে তুলে ধরলো। সবকিছু শুনে মেলে অপরিনামদর্শী রাহাতের প্রতি যার পর নাই ক্ষিপ্ত হয়ে জামিল ভাই ভারি কণ্ঠে বলল, "এখন এত রাতে আমার পক্ষে কি করা সম্ভব, মতিন তুইই বল? ওরা যা করে করুক। ওর সম্পর্কে আমার কোন দাবি নেই ।" পরে মতিন আবার অনুনয়-বিনয় করে বলল, "দেখেন মিয়াভাই, ও তো ভীষণ বিপদে পড়ছে। বুঝে হোক; না বুঝে হোক কাজটা করে ফেলেছে। এখন যেহেতু জীবন মরণের প্রশ্ন, আপনি একটু শান্ত হয়ে আমার পরামর্শ দেন, কি করব। ওরা তো টাকা না হলে ওকে ছাড়তে চাচ্ছে না। আবার প্রচণ্ড মারধরও করছে।" জামিল ভাই পরিস্থিতি বুঝে শেষমেষ আশ্বাস দিল যে, " তুই ওদের বুঝিয়ে শুনিয়ে কযে, কাল সকালে বাড়ি থেকে ছয় হাজার টাকা দিতে পারবে।" এরপর মতিন নিজে ঐ টাকার জামিনদার হয়ে এবং মোবাইলের লাউডস্পীকারে ওদের সেকথা শুনিয়ে অবশেষে আশ্বস্ত করতে সক্ষম হলো। তারপর রাহাতকে ছাড়িয়ে তামিম ভাই ও মতিন ম্যাচে চলে আসলো। তামিম ভাইকে কৃতজ্ঞতার বিদায় বিদায় জানিয়ে ওরা ম্যাচের রুমে প্রবেশ করল। এরপর ম্যাচে গিয়ে গামছা ভিজিয়ে ভিজিয়ে রাহাতের মাথায় পট্টি দিচ্ছিলো মতিন। ঐ সময় মতিনের মুখপানে চেয়ে আছে রাহাত আর প্রচন্ড মার খেয়ে অসহ্য ব্যথায় ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এরপর ওকে মাথায় পানি ঢেলে মাথা মুছিয়ে দিয়ে বেডে শুইয়ে রাখল মতিন। সকালবেলা বাড়ি থেকে লোকজন আসবে। তারপর তারা যেকোন একটা এসপার-ওসপার করবে। এই ভেবে মতিনও শুয়ে পড়ল।ভোর না হতেই ঐ উচ্ছৃঙ্খল ছেলেগুলো মতিনদের মেসের সামনে আবার হাজির হয়ে গেল। মতিনের রুমের জানালায় জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে ওরা বলছে, "সেই ছেলেটা কোই?" মতিন জানালা না খুলেই ভিতর থেকে বলল, "আছে, ও পাশের রুমেই ঘুমাচ্ছে।" "দরজা খোল। ও যেন কোথাও না চলে যায়....। টাকা দিবি তারপর এইখান থেকে যে যেখানে যাবি।" ওদের উত্পাত দেখে মতিন রাহাতের রুমে ওকে খুঁজতে গেলো। যেয়ে দেখে ও ওর বিছানায় নেই।
মতিনকে না জানিয়েই খুব ভোরেই ও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। এখন তো জানালার বাইরে থেকে মুহুর্মুহু চিত্কার আসছে। কেউ কেউ আবার জানালার পাল্লায় মাঝে মধ্যে বিকট শব্দে বাড়ি দিচ্ছে। মতিন তখন নিরুপায় হয়ে জানালার এক পাল্লা খুলে বলল, "ও একটু ওয়াশরুমে গেছে ফ্রেশ হতে, আসছে।" এ কথা শুনে তো ওরা মতিনের প্রতি আরো প্রচণ্ড ক্ষ্যাপা ক্ষেপে গেল। বলল, "তুই আমাদের সাথে মজা নিচ্ছিস? বিট্রে করছিস? তুই কেবল বললি, ও রুমে শুয়ে আছে, আবার এখন বলছিস ওয়াশরুমে। আগে দরজা খোলা, রুম দেখবো।" মতিন সময় ক্ষেপণের জন্য আর কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না। তাই হঠাত্ আবারো সে অসত্য কথার আশ্রয় নিতে গিয়ে বলল, "ভাই সত্য কথা বলতে কি, ও উপরে তামিম ভায়ের কাছে গিয়েছে। ভাই তার কাছে না শুনে দরজা খুলতে নিষেধ করেছে।" মতিন মূলত জানেনা, রাহাত কোথায় গেছে। মতিন শুধুমাত্র সময় ক্ষেপণ করছে যে, গ্রাম থেকে কখন লোক আসবে। এরকম চিন্তা আর বাইরে প্রেসার গ্রুপের অযাচিত পরিস্থিতির অস্থির ঘনঘটায় মতিন যখন বেসামাল তখন সে অকস্মাত্ দেখে পেছনের মূলগেট খুলে রাহাত গ্রামের কয়েকজন লোকসহ চুপচাপ রুমের ভিতরে প্রবেশ করছে। তখন ওদের দেখে এক বুক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল মতিন। মতিনের দেহে যেন নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হলো। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল মতিনের ধড়ে যেন আর প্রাণ নেই। যাইহোক, একটা সুরাহার ব্যবস্থা করার জন্য গ্রামের ওরাও কিছু মাস্তান গোছের পুলাপান সাথে করেই এসেছে। কিন্তু এইটা দেখে ওদের ভিতর আরো তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো। তাই তত্ক্ষণাত্ এক রগচটা মাস্তান টাইপের ছেলে মতিনের উপর চটে গিয়ে মারার উপক্রম হলো আর অসংলগ্ন ভাষা ব্যবহার করে বলে উঠলো, "টাকা দিবি তুই, তা না করে তুই দুদিয়ার নাঙ ডেকে নিয়ে আইছিস। তোর আজ মাথা ফাটিয়েই দেবো।" এইটা শুনে মতিনদের মধ্য থেকে একজন বলল, "মুখ সামলে কথা বলেন ভাই, ও আপনার কত সিনিয়র জানেন?"যাইহোক উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সামলিয়ে দুই পক্ষের লোকেরা রাহাতকে নিয়ে মোড়ের দিকে গেলো মিটিং করবে বুলে। গ্রামের বড়ভাইদের পরামর্শে মতিন আর মিটিংয়ে উপস্থিত থাকলো না। অবশেষে মেয়েটির পাতানো ফাঁদে আটকা পড়ে কিছু অযাচিত কষ্ট আর জরিমানার বিনিময়ে রাহাতের বিষয়টা ঐ খানেই সুরাহা হলো।আর এভাবেই অসংখ্যবার মতিন রাহাতকে বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্তের গেড়াকল থেকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু তাতেও যে ওর কোন শিক্ষা হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ এতবড় ঝড় যাওয়ার পরও ও আগের মতোই নিশ্চিতে খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, বেড়াচ্ছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে না ও কোনো পেরেশানিতে আছে।
এরপর কিছুদিন বাদেই মতিনের ম্যাচ থেকে রাহাত চলে গেল অন্য এলাকার এক নিরিবিলি বাসায়। তবে ওখান থেকে চলে গেলেও মতিন ওর খোঁজ খবর নিয়মিতই পেয়ে যায় । আর তাই একদিন ও শুনতে পেলো ওখানে গিয়েও নাকি রাহাত আরেকটা মেয়ের সাথে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। আর এভাবে ও প্রায় নিয়ম করেই একাক জায়গায় যায় আর একাক ঘটনা ঘটায়। তাই ওখানে গিয়েও তার কোনো ব্যতিক্রম হলো না। ওখানে ও একটা কোচিং সেন্টার খুলে বসলো। ফলে সেখানে নতুন পুরাতন অনেক ছাত্রছাত্রী ওর কাছে পড়তে গেলো। আর সেই মেয়েদেরই একজনের সাথে ও আবার প্রেমের নিগূঢ়তায় রোমাঞ্চিত হলো। মতিন কার কাছে যেন শুনতে পেলো, আষাঢ় মাসে রিমঝিম বৃষ্টির নরম স্পর্শে একই ছাতার নিচে নতুন প্রেমের দ্বিগুণ উদ্যমে উদ্বেলিত হয়ে চঞ্চল শুভ্র মেঘের মত ঘুরে বেড়ায় নব প্রেমের সেই আদুরে জোড়া কইতোর। খলখল হাসির উচ্ছল মৃদু দুষ্টুমির মাঝে চলে প্রেমের নানা মিষ্টি আলাপ। আর এটা একদিন ওর সহোদর ভাই ফাহাদের দৃষ্টিগোচর হয়। কারণ ও পাশেই একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস করতো। পরে একদিন মতিনের সাথে সাক্ষাত হলে এই কথাটি ফাহাদ মতিনের কাছে প্রকাশ করে। বিরক্ত আর অস্বস্তির আবেগে ফাহাদ বলে, "মতিন ভাই, ও কি যেখানে যাই সেখানে একটা করে প্রেম করে? এটা কি ওর স্বভাবে পরিণত হয়েছে!" সম্পর্ক যখন ক্ষীরের মত জমে উঠেছে তখন হঠাত্ ও একদিন মতিনের মেসে এসে বলছে, "ভাইয়া, জানো আমি না একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছি। ওই মেয়েটা দেখতে খুবই সুন্দর। কিন্তু দুঃখের বিষয় কি জানো, মেয়েটার বাবা অটো চালায় বিধায় আমার ফ্রেন্ড মহল থেকে শুরু করে পরিবারের কেউ তার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছে না। কিন্তু তুমি আজ চলো তো ভাইয়া মেয়েটাকে তোমার দেখিয়ে নিয়ে আসি। মেয়ের বাবা অভিভাবক নিয়ে যেতে বলেছে। তাই হবু শশুর বাড়ি তুমি কিন্তু আজ আমার অভিভাবক সেজে যাবে ভাইয়া।" একথা বলেই ও মতিনের আনলায় থাকা পাঞ্জাবীটা পরে নিল এবং সাথে সাথে মতিনও রেডি হয়ে চলল মেয়েটাকে দেখার উদ্দেশ্যে। মতিন কেন জানি বুঝতে পারতো না, ও রাহাতের কাছে ভাঙা কুলার মত ব্যবহার হচ্ছে। প্রয়োজন হলে সাথে আছে, নাহলে পড়ে থাকে ঐ গলির এক কোনায়। যাইহোক, মোড়ের দোকান থেকে রাহাত কিছু কদবেল কিনল। কদবেলের ব্যাগ হাতে নিয়ে একটা ইজিবাইকে তারা দুজন চেপে বসলো এবং সত্যি সত্যিই মেয়েটাকে দেখতে চলে গেলো। দেখাদেখির এক পর্যায়ে মেয়ের বাবা অভিভাবক মতিনকে বলছে, "ছেলেটা আপনার মত ভারবুদ্ধির হলে ভালো হতো। এমন একটা অপরিপক্ব ছেলের হাতে আমার স্কুল পড়ুয়া মেয়েটাকে তুলে দেব এটা আমার মন কোনো ভাবেই সাঁই দিচ্ছে না। আর আমার মেয়েটা তো এখনও ছোট, ক্লাস এইটে পড়ে মাত্র। ওকে আমরা এ মুহূর্তে বিয়ে দিবো না ভাবছি।" এই ধরনের অনেক কথাই উনি মতিনের সাথে বললেন। কিন্তু ওদিকে রাহাত তার হবু শাশুড়ির কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে নিজের সম্পর্কে অনেক এডভেটাইজই তুলে ধরার চেষ্টা করলো। কেননা, ও আবার বোঝানোর ক্ষেত্রে খুবই পটু। যেকোনো মানুষকেই কেমন জানি ও এক নিমিষেই পটিয়ে ফেলতে পারে।কিন্তু এক্ষেত্রে হবু শাশুড়িকে কিছুটা রাজি করাতে পারলেও লেখাপড়া শেষ হওয়ার দোহায় দিয়ে সেই দাওয়াটা কাটিয়ে দিলেন মেয়ের বাবা । যাইহোক, ওখান থেকে ওরা প্রত্যাখ্যাত হয়ে চলে আসলো। মেয়ের বাবা শহরের এক ভাড়া বাড়িতে থাকতো। মেয়ের উপর এমন উত্পাত দেখে তারা গ্রামের বাড়ি যাবার নাম করে কোথায় যে চলে গেল পরে তার কোনো হদিসই পাওয়া গেল না।
এরপর অনাঢ়ম্বর ভাবেই অনেকদিন কেটে গেল। ইতিমধ্যে রাহাত আবার বাসা চেন্জ করে অন্য এক জায়গায় বাসা নিল। সেখানেও একটা কোচিং সেন্টার খুললো। কোচিং চলছে বেশ জমজমাট। এরমধ্যে একদিন হঠাত্ করে রাহাত মতিনকে ফোন দিয়ে বলল, "ভাইয়া, তুমি একটু পুরোনো ব্রিজের ওখানে আসোতো।" "কিন্তু কেন?"রাহাত জিজ্ঞাসা করলো। "কথা আছে তাড়াতাড়ি চলে এসো না ভাইয়া।" রাহাত কি যেন একটা কাজে ব্যস্ত ছিল। রাহাতের ফোন পেয়ে ও হন্তদন্ত হয়ে সেখানে ছুটে গেলো। বলল, "কি হয়েছে বল।" রাহাত তখন মতিনের কাছে এসে বলছে, "ভাইয়া, আমি একটা মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছি। ওকে তো আমি বিয়ে করতে চাই। এখন কি করবো বলোতো। তুমি অভিভাবক হয়ে আমার বিয়েটা দিয়ে দাও না।" হঠাৎ কথাটা শুনে মতিনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কিছুক্ষণ শান্ত থেকে মতিন বলল, "বলিস কিরে ভাই! এইটে পড়া একটা মেয়ে নিয়ে তুই চলে এসেছিস! ওর এখনো বিয়ের বয়স হয়েছে? এতে তোর ছাত্রীর অভিভাবকই বা কি বলবে? আর আমি একজন বিবেকবান মানুষ হয়ে এটাই বা আমার পক্ষে কিভাবে সম্ভব?" কিন্তু একথা গুলো ওর মুখের সামনে আরো নেতিবাচক ভাবে বললে হয়তো ও সিনক্রেট করবে। ও বিগড়ে যাবে বা হয়তো কথা শুনতে চাইবে না। তখন অন্য একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে ভেবে মতিনরা অন্য পথে হাঁটলো। এ কারণে রাহাতের সাথে থাকা এক বন্ধু সেলিম এর সাথে মতিন পরামর্শ করলো যে, "এখন কি করা যায় বলোতো সেলিম? ওতো খুবই নাছোড়বান্দা। ঐ মেয়েকে তো ও বিয়ে করেই ছাড়বে।" তখন সেলিম মতিনকে বলল, " মতিন ভাই, একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমরা সবাই মিলে ওকে বোঝাই যে, এখন বিয়ে করতে হলে অনেকগুলো টাকা খরচের প্রয়োজন পড়বে। দেনমোহরের জন্য, কিছু সোনার গয়না ক্রয়ের জন্য; উকিলকে টাকা দেয়ার জন্য বেশ কিছু টাকার প্রয়োজন। আগে তুই এগুলো সংগ্রহ করে নে..
Comments
Post a Comment