স্বার্থপর বন্ধুঃ পর্ব-3
পর্ব-3: স্বার্থপর বন্ধু
মোঃ এনামুল হক
এরপর প্রায় চল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেল; কিন্তু তার আসার কোনো খোঁজ খবর নেই। এরপর রবিন আবার রাহাতকে ফোন দিয়ে বলল, "তোর এত দেরি হচ্ছে ক্যান? আমি বাইরে যাব, তুই তাড়াতাড়ি আয়। অবশেষে প্রায় এক ঘন্টা পরে বাটির ভিতরে কিছু বিরানি ভাত আর মাংস নিয়ে ওটা রবীনকে দিতে এসেছে। দেরির কারণ স্বরূপ সে বলে, "আরো কিছু জায়গায় আমি এগুলো দিতে গেছিলাম তো। তাই একটু আসতে দেরি হয়ে গেছে দোস্ত। তুই কিছু মনে করিসনে।" রাহাতের এমন মানসিকতা রবিনের মনে প্রচন্ড লাগা লেগেছে। কারণ, রবিন ভাবছে, "আমি দিলাম ওর বিপদে হাত বাড়িয়ে। আর সেটা ও ঋণ পরিশোধ করার প্রেক্ষিত হিসেবে বাটিতে করে বিরানি নিয়ে আসছে আমার কাছে ! আর এটা ওর ইগোতে প্রচণ্ড ধাক্কায় বাড়ি দিলো। এরপর রবিন কোন প্রকার রাখঢাক না রেখেই রাহাতের ঘাড়ে হাত রেখে বলল, " আচ্ছা বলতো! তোর কি মনে হয় তুই আমাদের সব ঋণ শোধ করতে পেরেছিস? তখন রাহাত বলে, "নারে দোস্ত, তোর এই ঋণ কি কখনো শোধ করা যায়রে দোস্ত? প্লিজ, তুই এটাকে অন্যভাবে নিস্ না।"
রবিন বলে, "তাহলে তুই বিরানি নিয়ে এসেছিস ক্যান? ভেবেছিস, এইটা আমরা কোনো দিন খাইনা তাই? আর সেজন্য ওটা তোর হাতে উপঢৌকন স্বরূপ দেখতে পেরে আমি খুব খুশি হয়ে যাব, তাই না? আরে বাহ্! যারা তোকে হসপিটালে একটু খাবার দিয়ে, একটু সেবা-শুশ্রুষা দিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে তাদের প্রত্যেককে তুই এরূপ স্বাদের বিরানি খাইয়ে সব ঋণ পরিশোধ করতে পারবি? তুই যাই ক্যস দোস্ত, এটা তুই কোনো মতেই ঠিক কাজ করিসনি, রাহাত।
একদিন রাহাতের উপস্থিতিতে তার এক ক্লোজ বন্ধু আরাক বন্ধু মিশুর নামে যেন কিছু একটা সমালোচনা করেছিল। রাহাতের আবার মাঝেমধ্যে খুব ভালো হওয়ার প্রবণতা প্রচণ্ডভাবে জেগে ওঠে। তাই বন্ধু সম্পর্কে এরূপ সমালোচনাটা হঠাৎ ওর কাছে যেন একটা গীবতের চরম পর্যায় বলে মনে হয়েছে।সেকারণে এই কথাগুলো ওর সংশ্লিষ্ট বন্ধুদের একদমই বলা তা ঠিক হয় নাই। আর এটা যে ঠিক হয়নি সেটা সে তার অনুপস্থিতি বন্ধু মিশুর কাছে বলে নিজেকে সুপারলেটিভ ডিগ্রিতে ভালো সাজাতে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, এই কথাটা শুনে তার সেই বন্ধু মিশু সমালোচনাকারী বন্ধুর উপর যারপরনাই দুঃখ পেয়েছে। এ কারণে যারা সমালোচনা করেছে তাদের সাথে বন্ধু মিশু কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছে। স্বভাবতই সমালোচনাকারী ঐ দুই বন্ধু বুঝতে পেরেছে নিশ্চয়ই কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। তা নাহলে মিশুর এমন হঠাত্ কথা বন্ধ করবে কেন? এরপর একদিন এ বিষয় নিয়ে রোহিতের দোকানে মিটিং বসানো হলো। সেখানে সবাই উপস্থিত হয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিটা মিটিংয়ে উপস্থাপন করলো। তখন অনেক কথাবার্তার মাঝে রবিন তার অপরাধ স্বীকার করে মিশুর কাছে ক্ষমা চাইল। অনিচ্ছাকৃতভাবে কথার ফাঁকে অথবা বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো আমার ভুল হয়ে গেছে। তুই দোস্ত হয়ে ক্ষমা করে দে। এই ক্ষমা চাওয়ার পর বন্ধুদের মধ্যে ভালোই চলছে। এমনকি রবিন এবং মিশুর ভিতর আগের চেয়েও যেন সম্পর্ক এখন বেশি মাখামাখি। পাশাপাশি এটার জন্য আবার মিশুর মধ্যে রাহাতের প্রতি একটু খারাপ লাগাও তৈরি হয়েছে। কারণ রাহাত যে বন্ধুত্বের ভিতর ফাটল ধরানোর জন্য এবং নিজেকে মিশুর কাছে ভালো সাজার বিষয়টি উপস্থাপন করার চেষ্টা করছিল সেটা ভালো করে বুঝতে পেরেছে মিশু। আর এই বিষয়টাও রাহাত কিভাবে যেন আচ করতে পেরেছে। তাই একটা দিনক্ষণ ঠিক করে সে রবিনসহ সকল বন্ধুকে খবর দিয়েছে একটা চায়ের দোকানে। খবর দিয়ে রাহাত খপ করে রবিনের পা চেপে ধরে বসে। তারপর রবিনের ইতস্ততঃ ভাব আর পা ছাড়ার অনুরোধে রাহাত অবশেষে উঠে দাঁড়ায় এবং রবিনের হাত ধরে বলে, "যেটা হয়েছে সেটার জন্য আমি ভীষণভাবে লজ্জিত, তুই আমাকে ক্ষমা করে দে দোস্ত। কথা দিচ্ছি ভবিষ্যতে এরকম আর হবেনা।" এ পর্ব শেষ হবার পর গল্পের এক ফাঁকে হঠাৎ রাহাত আবার বলে ওঠে, 'আমার আরো দুজনের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে দোস্ত।" যা কথা তাই কাজ। পরের দিন গ্রামে গিয়ে রাহাত সেই দুজন মহিলা আল্লাদি আর জরিনা ভাবির কাছে ক্ষমা চেয়ে শহরে চলে এলো। হুটহাট সিদ্ধান্তে ওর মনে হয়েছে এদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, তো হবে। এর কোনো কারণ বা ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করাও আবার আরেক মুশকিলের কাজ। তাই সবার মনে হয়ত একই মন্তব্য অনুরণিত হলো যে, ও যা পারে তাই করুক। খারাপ তো কিছু হচ্ছে না।
যাইহোক আরেক দিন রাহাত ম্যাচে হাঁটার জায়গাটা ঝাড়ু দিয়ে খুব সুন্দর করে পরিষ্কার করে রাখে। এইটা ম্যাচের একটা ছেলে বুঝতে না পেরে সেখানে জুতা রেখেছে। জুতা রাখার কারণে রাহাত মৃদু কিন্তু ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলছে, "এখানে জুতা রাখল কে?" বুঝতে না পেরে ছেলেটির সরল উত্তর, "আমি রাখছি ভাই। কেন কি হয়েছে ভাই? রাহাত নরম অথচ হুমকির সুরে বলল, না কিছুই হয়নি, তবে হতে কতক্ষণ? ছেলেটা অবচেতন মনে ওই বিষয়টা ভুলে গিয়ে তার বন্ধুদের সাথে গল্পে মেতে গেল। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে রাহাতের মনে প্রতিশোধের স্পৃহা এমন ভাবে জাপ্টে গিয়েছে যে, ছেলেটাও জানতে পারে নাই তার কপালে কি হতে চলেছে। পরের দিন ঠিকই গুটি কয়েক মাস্তান ছেলে ম্যাচে এনে জুতা রাখা ঐ ছেলেটাকে আচ্ছা রকম মারধর শুরু করল। পরে মতিন ওকে বলল, "তুই কাজটা কী ঠিক করলি রাহাত? মানুষের জীবনে ঐশ্বরিক প্রতিশোধ বলেও কিছু একটা বিষয় থাকে। এ যে তুই মারলি; এই মার যে তুইও একদিন খাবি না , তার কি কোন গ্যারান্টি আছে? এতোটুকু অপরাধে কেউ এরকম প্রতিশোধ কেউ নেয়? তোর কাজকাম আমার কাছে খুবই উল্টাপাল্টা লাগেরে ভাই।
মসজিদে জুতার বক্স থাকবে কেন এই নিয়ে একদিন মতিনের সাথে সে প্রচন্ড তর্কে মেতে উঠলো......
Comments
Post a Comment