স্বার্থপর বন্ধুঃ পর্ব-2
পর্ব-2: স্বার্থপর বন্ধু
মোঃ এনামুল হক
তখন মতিনদের এই সাধারণ চটকদার কথায় ও কেন যেন রাজি হয়ে গেলো তা জানা গেল না। কারণ, ও খুব চালাক আর বাঁদর টাইপের একটা ছেলে। প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ, আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থপরতা মণ্ডিত একগুঁয়ে ধাঁচের বৈশিষ্ট্যও ওর মাঝে বিদ্যমান। তাই যেটা ও করে তা খুবই জান প্রাণ দিয়েই করে। তা সে নামাজই হোক, মারামারিই হোক আর কারো মনে কষ্ট দেবার বেলায়ই হোক। কিন্তু মতিনের ওকথাটা কেনযে ও বিশ্বাস করল তা মতিন বুঝতে পারলো না।
যাইহোক, নানা তাল বাহানা করে মেয়েটাকে অবশেষে বাড়িতে পাঠানো সম্ভব হলো। এদিকে রাহাত অপেক্ষা করতে থাকলো কখন সে টাকা জোগাড় করবে এবং তাদের বিয়েটা সম্পন্ন হবে। মতিনরা জানতো, ওই মেয়েটা একবার অভিভাবকের কাছে যেয়ে পড়তে পারলে আর কোনো সমস্যা নেই। কারণ, অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের অভিভাবকরা কোনো না কোনো ভাবে বিষয়টি জানতে পারবেই। আর তারা জানতে পারলে তখন তারা ভেবে চিন্তে কি করবে সেটা তারা সিদ্ধান্ত নিবে। এখনতো অন্তত একটা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিবাহ ঠেকানো গেলো।
পরে ঐ মেয়েটি কোচিং এ আসা তো দূরের কথা আর কোনো দিন ওর সাথে যোগাযোগই রাখেনি। ফলে বোধ হয় এখনকার মতো এ ভূতটাও ওর মাথা থেকে নামলো। এরপর বেশ কিছু দিন পর সম্ভবত বাসার মালিকের সাথে ভাড়ার ক্ষেত্রে পড়তা না হওয়ায় ওখান থেকে ও কোচিংটা গুটিয়ে নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে চায়। এজন্য বাসার মালিক টের পাওয়ার আগেই ওকে খুব ভোরে ওর বেঞ্চ ও তল্পিতল্পাসহ ঐ বাসা ত্যাগ করতে হবে। কারণ বাড়িওয়ালা জানতে পারলে ভাড়া পরিশোধ না করে জিনিসপত্র সরাতে দেবে না। তাই দীর্ঘ দিন যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও, হঠাত্ তার প্রয়োজনে সে আবার মতিনের শরণাপন্ন হলো। মতিন রাহাতের মিষ্টি কথার কাছে হার মেনে আবারও নাওয়া-খাওয়া ভুলে পরের দিন খুব ভোরে অনুগত ভৃত্যের মতো ওর সাহায্যে হাজির। তারপর মতিনের সাথে করে রাহাত প্রাচীর টপকিয়ে বেঞ্চসহ বাসার সকল জিনিসপত্র একে একে পার করলো পাশেই আরেকটি সস্তা ভাড়ার টিনশেটের বাসায়। সেখানে গিয়ে রাহাতের মাথায় পরিকল্পনা আসলো, কোচিং এর পরিসর আরো বড় করতে হবে। এর জন্য দরকার প্রচারণা। আর তাই আবার সেই মতিনকেই ও বাইসাইকেলের পেছনে চড়িয়ে দারে দারে স্টুডেন্ট সংগ্রহে বেরিয়ে পড়ে। কারণ, অনভিজ্ঞ ভেবে ওর কাছে পড়াতে অভিভাবকরা ইতঃস্তত বোধ করবে; তাই মতিনকে পিছে নিয়ে ঘোরা আরকি। অথচ উদ্বোধনের দিন মতিনকে বাদ রেখেই ও ওর পরিচিত চটরপটর কথা বলতে পারা কিছু জনপ্রিয় কোচিং শিক্ষক ও বন্ধুবান্ধব এবং কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ নিয়ে কোচিংটা উদ্বোধন করে। মানুষের ভালোবাসাটা যখন কেউ দুর্বলতা হিসেবে নেয় তখন তার আর কিছুই করার থাকে না। আর রাহাত বারবার এই কাজটাই করত মতিনকে নিয়ে। মতিন নিঃস্বার্থভাবেই সময় দিত রাহাতকে। কিন্তু রাহাত শত ব্যস্ততা দেখিয়ে নিজের লাভ ছাড়া মতিনকে কখনোই ঐভাবে সময় দিতে চাইতো না।
মতিনের পড়াশুনা শেষ হওয়ায় ও ম্যাচ ছেড়ে বাড়িতে চলে এসেছে। তাই একদিন ও কালাচানের লিচুতলায় চাকরির পড়া পড়ছিল। তখন হঠাৎ করেই সে লক্ষ্য করে, রাহাত, সৌরভ এবং ওর আশেপাশের কয়টা ফ্রেন্ড মিলে পাশের এক পায়ো রাস্তা দিয়ে দল বেধে কোথায় যেন যাচ্চে। রাহাতের হাতে একটা সালার বস্তা আছে। ছোট লিচু গাছের ঝাপড়ানো পাতা চারিদিকে থাকায় ওরা মতিনকে দেখতে পারছে না, কিন্তু মতিন ঠিকই নিচ থেকে ওদের সমগ্র কাজ পর্যবেক্ষণ করতে পারছে। মতিন ওদের সন্দেহজনক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটু চুপ করে রইল এবং পড়ার বই থেকে তার চোখটা কিছুটা অর্ধনমিত করে ওদের কার্যাবলী ইতঃস্তত বিক্ষিপ্তভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ওরা প্রায় পাঁচ/ছয় জন বন্ধু মিলে দ্রুত বেগে রাহাতদের নারকেল বাগানের দিকে চলে আসছে। এরপর দেখা গেল ওদের মধ্য থেকে একটা ফ্রেন্ড সড় সড় করে নারকেল গাছে উঠে পড়ল। মতিনের মনে প্রশ্ন জাগলো, রাহাত গ্রামে এসে হঠাত্ নারিকেল গাছে ওঠার কারণ কি? সংশয়ের ঘোরে মতিন তখন দেখতে পেলো, বন্ধুরা গাছ থেকে ডাব পেড়ে তা রাহাতকে খাওয়াচ্ছে, আবার নিজেরাও খাচ্ছে। নিশ্চিত ভাবেই বোঝা গেল রাহাত কি যেন একটা সমস্যায় পড়ে গ্রামে এসেছে। গ্রামে এসে ও বন্ধুদের সাথে মিটিং বসাবে আর সমস্যা নিয়ে শলাপরামর্শ করবে। আর এমনটা ও প্রায়ই করে থাকে। ওর জন্য মিটিং বসাতে বসাতে আশপাশের বন্ধুগণ প্রায় হয়রান হয়ে গেছে। ওর সমস্যা তৈরি করতেও যেমন সময় লাগে না আবার তা সমাধানের উপায় পেতেও দেরি লাগে না। প্রতিবারের আচরণে ওর প্রতি মানুষের বুকে বিন্দু বিন্দু রাগ,অভিমান ও কষ্ট জমা হয়। এ ব্যাপারে ও অবচেতন মনে থাকলেও অন্যরা ঠিকই তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারে। আর তাই এখন রাহাতের কোনো কৃত্রিম বিপদে মতিনের মনে তেমন কোন দাগ কাটে না। অবহেলায় জর্জরিত হৃদয়টা এখন কেমন জানি পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। যাইহোক, মতিন দেখলো, ওরা পাশের আমবাগান অতিক্রম করে আঁকাবাঁকা পথটা ধরে নদীর ধারে কালা চানের বাঁশতলায় গিয়ে বসলো। সেখানে তারা নারিকেল, ডাবের পানিসহ আরো অনেক কিছুই পান করছে আর রাহাতকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, "এরকম একটা মেয়েকে তোর বিয়ে করা ঠিক হবে না রাহাত। যার দুই দুইটা ছেলেপেলে রয়েছে। এই মানুষটারে তুই বিয়ে করিস না দোস্ত।" এভাবে নানান কথার প্রলোভনে তাকে বোঝানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু পরে জানা গেছে, রাহাত তাদের কোন কথাই তখন মেনে নিতে চায়নি। তাই অবশেষে ও ওখান থেকে উঠে দৌড় দিলো। দৌড়ে সামনে একটু এগোতেই ও মতিনের চোখে পড়ে গেলো। ফলে রাহাত সেসময় চোখ এড়াতে না পেরে ও হাঁপাতে হাঁপাতে এসে মতিনের পড়ার পাটিতেই গড়িয়ে পড়ল। মতিন বলল, " আরে রাহাত! কি হলো তোর? পাগলা ঘোড়ার মতো তুই ছুটে বেড়াচ্ছিস ক্যান?""তেমন কিছু না"-বলেই ও বিষয়টা স্বযত্নে এড়িয়ে গেলো এবং মতিনের কাছ থেকে সামনের দিকে আবার দ্রুত দৌড়ে চলে গেল। সামনে যেতে দেখে মতিন কেন জানি একটু হিয়ালি করে নাছোড়বান্দার মত ছোট্ট দৌড়ে ওর নাগাল পেতে চেষ্টা করলো। কি হয়েছে জানার জন্য মতিন অবচেতন মনে একটু কৌতূহলী হয়ে উঠলো। অথচ রাহাত দ্রুত সামনে অগ্রসর হয়ে জনপদে মিলিয়ে গেল এবং মতিনও অতঃপর ওর প্রতি অত উতসাহ না দেখিয়ে নিজের অবস্থানে আবার ফিরে এলো। রাহাত কিছু না বললেও মতিনের আচ করতে বাকি রইলো না যে, আজকেও হয়তো কোন নারী ঘটিত ঘটনায়ই রাহাত হাবুডুবু খাচ্ছে যা কিছুতেই সেটা ওর কাছে বলতে চায় না।কেননা এর আগে তার কাছে বলার কারণে রাহাতের কোনো উদ্দেশ্যই ফলপ্রসূ হয়নি। তাই মতিনকে শেষোক্ত ঘটনাটা ও কোনো মতেই মতিনকে বলবে না।
যাইহোক, অনেক দিন পর সচরাচর এক পিকনিকে অংশ নেওয়ার জন্য রাহাত গ্রামে আসে। পিকনিক চলার মাঝে হঠাত্ করেই যেন কোথায় উধাও হয়ে গেলো রাহাত। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে নাতো যাচ্ছেই না। অনেকক্ষণ খুজাখুঁজি করার পর, অবশেষে অপরিচিত এক নাম্বার হতে গ্রামের এক বন্ধু দবিররের ফোনে ভেসে আসলো, "দোস্ত, আমি ভীষণ বিপদে আছি। তোরা যেখানেই থাকিস আমাকে সাহায্য কর প্লিজ।" গ্রামের বন্ধুরা তখন ওর সেই মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করে তখনই চলে গেল তাকে উদ্ধার করতে। এদিকে সকাল হতে না হতেই একথা গ্রামের সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল।
গেঁয়ো ভাষায় জনশ্রুতি হয়ে গেল, " রাহাত দুই সন্তানের এক মাকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে।" শেষমেশ অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে দবিরসহ অন্যান্য বন্ধুরা মিলে ওকে বিয়ে দিয়ে অজ্ঞাত কোন এক আত্মীয় বাড়ি রেখে তারপরই বাড়ি ফিরলো। এরপর বাড়ি ফেরা ওদের থেকেই মূল রহস্য জানা গেলো, রাহাতের সদ্য প্রতিষ্ঠিত কোচিংয়ে একই পরিবারের দুই ভাই বোন পড়তে আসতো। একটা পড়তো সেভেনে আর একটা ফাইভে। তাদের মা প্রতিদিন তাদেরকে কোচিং সেন্টারের দিয়ে যেত। এমতাবস্থায় অভিভাবকের মোবাইল নাম্বার নেয়ার সূত্রে ছাত্র ছাত্রীর ভাল মন্দ নিয়ে মায়ের সাথে প্রায়ই কথা চলতো রাহাতের। এক পর্যায়ে ঐ ছাত্র ছাত্রীর মায়ের সাথে রাহাতের একটা গভীর ভাবের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। তারপর ভাব থেকে ভালোবাসা, ভালোবাসা থেকে প্রনয়, প্রনয় থেকে শেষপর্যন্ত সেটা এই বিয়ে পর্যন্ত গড়ালো। রাহাত এর আগে অনেক জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও, বিবাহিত চালাক মহিলাটা তাকে এমন ভাবে প্রলোভনের জালে আটকে ফেলল যে, রাহাত এই দফায় পালানোর আর কোনো উপায়ই খুজে পেল না। এবার ঐ মহিলা স্বামী, সন্তান আর সোনার সংসারসহ সর্বস্ব ফেলে আটঘাট বেঁধেই তবে চলে এসেছে। এরপর কাঁচা যৌবনে বিয়ের কিছু রমরমা দিন অতিক্রান্ত হবার পর ওর টাকা পয়সার টান পড়ে যায়। ফলে রাহাত ওর এক কাছের বন্ধুকে ফোনে বলে, "অমক জায়গায় আমার কাপড়-চোপড়ের বাক্সটা আছে। তুই আমার বাক্সটা একটু দিয়ে যা..না দোস্ত!" অথচ ঐ বাক্সের ভিতরে যে বেশ কটা টাকা ছিল তা বহনকারী ঐ বন্ধুকে সে বলেই নি। কেননা ও ভেবেছে, টাকার কথাটা জানিয়ে দিলে হয়তো বহনকারী ঐ বন্ধু সেটা নিয়ে নিবে। এই কথাটা যখন বহনকারী বন্ধু কোনো না কোনো ভাবে জানতে পেরেছে, তখন রাহাতের প্রতি সে এত রুষ্ট হয়েছে যে, আর যাই হোক রাহাতের কোনো বিষয়ে সে এখন আর মুখ তুলেও তাকায় না।
ওদিকে মহিলাটির সাবেক স্বামীর বাড়ির এলাকায়ও হুলুস্থুল পড়ে গেছে যে, উসমানের বউ দুইদুটো মাসুম সন্তান ফেলে রেখে অন্য জনের সাথে ভেগে চলে গেছে। আর তাকে এখন কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে নাতো যাচ্ছেই না। নিরুপায় হয়ে অবশেষে সেই স্বামী পক্ষ থানায় এসে রাহাতসহ রাহাতের সত্ভাই জামিলের নামে কেস ফাইল করে। ফলে পরবর্তীতে তাদের নামে দ্রুতই পুলিশ ওয়ারেন্ট বেরিয়ে যায়। তখন রাহাতকে না পেয়ে পুলিশ ওর সত্ ভাই জামিলকে থানায় ধরে নিয়ে যায়। থানা, পুলিশের অভিজ্ঞতা জামিলের কোন দিনই ছিলো না। আর তাতে ছিলো ওটা রোজার মাস।
রোজার ভিতর জামিলের সে যে কি কষ্ট! পরে ছাড়া পেলে, সেই কষ্টের কথা এসে জামিল গ্রামের মানুষের কাছে অবলীলায় শেয়ার করে,"ওর জন্য, শুধুমাত্র ওর গোয়ার্তুমির জন্যই আমাকে আজ এই জেলের ভাত খাইতে হল।"এরপর শোনা যায়,রাহাতের বউয়ের উপযুক্ত বিবৃতিতে জামিল ছাড়া পায়। কারণ সে কোর্টে উঠে বলে, "আমি স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে সুস্থ মস্তিষ্কে রাহাতের সাথে চলে আসছি। এতে অন্য কারো হাত নেই।" যাইহোক, এইভাবে ও মোটামুটি সব কাছের মানুষগুলোর মনে বিষের মত আঘাত দিয়ে রেখেছে। যে কারণে চাকরি না পেয়ে অভাব অনটনের নানা অভিযোগ নিয়ে যখন বাড়িতে যায় তখন ও কারো সাপোর্ট তো পায়ই না বরং নানা তিরস্কারের স্বীকার হয়ে আবার ফিরে যায় শহরের ভাড়া বাড়িতে। নানা মিষ্টি কথার প্রলোভনে তখন কারো মন যেন আর গলেনা।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, রাহাত যেন এখন প্রচন্ড জেদী, একগুঁয়ে এবং আত্মকেন্দ্রিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছে গেছে । ও সব সময় নিজের উপকার বা নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে। অথচ সেক্ষেত্রে একজন যে ওর স্বার্থের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বা ব্যথা পেতে পারে অথবা মনঃকষ্টে মূর্ছা যেতে পারে, এ বিষয়ে তার মনে কোন প্রকার রেখা পাতই করে না। তাই ফ্রেন্ডরা মাঝে মধ্যে একত্র হলে ওর সম্পর্কে প্রায়ই অভিযোগ করে, "আসলে ও প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই এমন করে। যখন যে ফ্রেন্ডের প্রয়োজন হবে অথবা তার কাছ থেকে স্বার্থ উদ্ধার করা লাগবে তার সাথে ও এত সুন্দর করে কথা বলবে, এমন সুন্দর আচরণ করবে, তা ঐ মন্ত্রমুগ্ধ লোকটা ঘুনাক্ষরেও জানতে পারবে না যে সে কেন তার থেকে এতো কথার আপ্যায়ন পাচ্ছে।" অর্থাত্ মিষ্টি কথার আড়ালে এবং আত্মকেন্দ্রিকতার খোলসে রাহাত দিনের পর দিন বেহায়া বিবেকটাকে সঙ্গী করে তার সকল স্বার্থই উদ্ধার করার চেষ্টা করে। এভাবে প্রথম প্রথম বুঝতে না পেরে অনেক ফ্রেন্ডই তার কাছ থেকে স্বার্থপরতার চরম অভিজ্ঞতায় কাতর হয়েছে। তবে এখন সবাই বুঝতে পেরেছে তার ঐ আত্মকেন্দ্রীক কোন কাজে তাদের আর অগ্রসর হওয়া ঠিক হবে না, যদিও রাহাত সেটা সে বুঝেছে কিনা তা সবার কাছে এখনো একটা বিস্ময়। কেননা, এটা লক্ষ্যণীয় যে, রাহাত আজও তার সেই পুরনো ধাঁচের শানিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে।ওর এরূপ আচরণের কারণে অনেকেই অনেক বেশি কষ্ট পায়। তাই তারা আবার বেশি আবেগী অভিমানে সেগুলো অন্যদের সাথে ব্যক্ত করার চেষ্টা করে। অনেকে বলে ফেলে, ছেলেটা মায়ের স্বভাব পেয়েছে। কেননা ওর মা ছেলে সন্তান ফেলে রেখে অনেক জিদ করে ওর পিতার কাছ থেকে ডিভোর্স নিয়ে আরেকজনের সাথে সংসার পেতেছে। রাহাতও ঠিক ওরকম জেদের বশবর্তী হয়ে নানান কাজ করে বসে যেগুলো আসলে সবার কাছে সামাজিক বলে মনে হয় না।
মতিনের তখন মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ। এরপর চাকরির পড়াশোনার জন্য ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ম্যাচ থেকে জিনিসপত্র বাড়ি নেওয়ার সময় ভাবল, ডেক্সটপটা রাহাতের কাছেই রেখে যাবে। রাহাতও সে সময় বলল, "ভাইয়া, এই নাও দুই হাজার টাকা। যদ্দিন তুমি না ফিরো আমি এটা ব্যবহার করবানে।" ঢাকায় যাওয়ার সময় অবশ্য মতিনের কাছে রাহাত কিছু টাকা ধার চেয়েছিল। সেইজন্যই কি রাহাতের এই কৌশল তা কে জানে। যাইহোক, ঢাকার পথে রওয়ানা হওয়ার সময় পকেটে যথেষ্ট টাকা না থাকায় মতিনও ধার স্বরূপ টাকাটা কেমন যেন নিয়েই নিলো। এরপর মতিন ঢাকা থেকে ফেরত আসলো। মতিন কম্পিউটারটা নিতে চাইতো না। কিন্তু ওর এত উগ্র আত্মকেন্দ্রিকতার এক্সট্রিম প্রকাশ যেটা কোন সুস্থ মানুষের কল্পনায় আসাও দুষ্কর। কেননা মতিন যখন ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরতো তখন দেখা যেত যশোরগামী গাড়িগুলো পায়রা চত্বরে রাত একটা/দুইটায় সময় ড্রপ করে দিয়ে চলে যেত। তখন মাঝেমধ্যে হয়তো গ্রামের বাড়ি যাওয়ার কোন যানবাহন পাওয়া যেত না। তাই অগত্যা নিরুপায় হয়ে শেষ ভরসা হিসেবে পরিচিত কাছের মানুষের আশায় ওকে ফোন দিতো। অথচ কোন একটা সিঙ্গেল ফোন তো ও কোনোদিনই ধরতো না বরং যদি ধরেই নিই ও ঘুমের জন্য টের পায় নাই বা ফোন সাইলেন্ট ছিলো, তবুও তো তার ব্যাখ্যাটা অন্তত দিতে পারতো। সেসব তো দূরের কথা ও কোনো প্রকার ফিডব্যাকই দেয় না। অনেক দিন পরে যদি ওর সাথে দেখা হয় বা কথা হয়, ওর এটিচিউডটা ও বুঝতেই দেয় না যে ও আমার ফোন রিসিভ করেনি। পরবর্তীতে দেখা যায়, নিয়মিত ও এটা করে যায়। ওর ফোন স্ক্রিনে আট/দশবার রিংটন বেজে সেটা মিসড কল হিসেবে জমা থাকলেও, সেটাতে ওর কোনো রিয়্যাকশন বা প্রতিক্রিয়াই মতিন লক্ষ্য করতো না যে, সরি দোস্ত ফোন ধরতে পারিনি... আমি ব্যস্ত ছিলাম বা ঘুমিয়ে গেছিলাম। এ ধরনের কোন এক্সকিউজও ওর ভিতরে দেখা যেতো না। দিব্যি ভালো মানুষের মতন ঘুরে বেড়াতো। দেখা যেত ও মতিনের সাথে একদমই স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে কথা বলছে । দেখা হলে মতিন কখন এসেছে তা ও স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞাসা করতো। ভাবে বোঝাতে চাইতো, তেমন কিছুই হয়নি ওর সাথে। তখন ওর এরকম আচরণ দেখে মতিনও ওর মতই স্বাভাবিক ভাব প্রকাশ করতো। মতিন মনে মনে ভাবতো, "মানুষ কিভাবে এত আত্মকেন্দ্রিকতা প্রকাশ করতে পারে? অথচ এরূপ একটা মানুষের কাছে আমার ডেক্সটপটা দু'বছর ধরে পড়ে রয়েছে তাতে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই!" এরপর মতিন ওর কাছে একদিন ফোনে বলল, "ডেক্সটপটা যে লাগে রাহাত। আমিতো ঢাকা থেকে বাড়ি চলে এসেছি। তাই বিভিন্ন পরীক্ষার ক্ষেত্রে প্র্যাকটিসের জন্য এটা আমার লাগবে। এটা আমাকে দিয়ে দে।" অথচ ওর আশ্বাসে মতিন সেটা নিতে গেলে ওকে রীতিমতো অপমানের স্বীকার হতে হয়। ও বলে যে, "আগে আমার দুই হাজার টাকা দিয়ে যা, তারপর তোর কম্পিউটার নিয়ে যাবি।" ধার নেওয়া টাকা ও যে কম্পিউটারের বিনিময় হিসেবে জিম্মি করবে তা মতিনের কল্পনায়ও ছিল না। আশ্চর্য ! ছোটবেলা থেকে যাকে মতিন এত ভালোবাসে, এত কাছে রাখে, এত আপন মনে করে সে মানুষটা শেষ পর্যন্ত তার সাথে এরকম একটা কাজ করতে পারবে তা মতিনের বিশ্বাসেই আসছিলো না। যাইহোক, মতিন তারপর সাথে সাথে ঢাকায় থাকা তার এক ছোট ভাইকে ফোন দিয়ে বলল, "ওয়াসিম, তুমি তাড়াতাড়ি আমার বিকাশ নম্বরে দুই হাজার টাকা পাঠাও তো। আমি একটু পরে তোমাকে সেটা দিয়ে দিচ্ছি।"ও সাথে সাথে মতিনকে টাকাটা বিকাশ করে দিয়ে দিল। একবার জিজ্ঞাসাও করল না যে, কি প্রয়োজনে টাকাটা চাচ্ছে। একবার চিন্তা করে দেখুন যার সাথে ঢাকায় দুই বছর মাত্র পরিচয় । রাহাতের মত অত ক্লোজও ছিল ওয়াসিম। সে শুধুমাত্র মতিনের বিপদের কথা চিন্তা করেই সাথে সাথে টাকাগুলো বের করে দিল। অথচ রাহাতের সাথে মতিনের সেই ছোটবেলা থেকে সখ্যতা। তখন থেকেই মতিন ওকে ছোট ভাইদের মত আগলে রেখেছে। পড়াশোনায় কোথাও আটকে গেলে ডাকামাত্র ছুটে গিয়ে হেল্প করেছে। অসহায়ত্বের সময় বিভিন্ন কথা বলে সান্ত্বনা দিয়েছে এবং স্বপ্ন দেখিয়েছে বড় হবার। বিভিন্ন কষ্টের কথা শেয়ার করলে সেগুলোকে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করেছে। অথচ এমন একটা মানুষের কাছ থেকে এভাবে টাকার ব্যাপারে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে আসবে বা স্বার্থপরতার চরম উদাহরণ স্বচক্ষে দেখে বাড়ি ফিরবে তা মতিন কখনো চিন্তাও করিনি।
অথবা এটা মতিনের কল্পনার জগতের ভাবনায় কখনোই উদয় হয়নি যে, ওর সাথে অন্তত এরকম একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা হতে পারে। কিন্তু সেটাই ছিল বাস্তবতা। যাই হোক, দুই হাজার টাকা ফেরত দিয়ে ওর কাছ থেকে ডেক্সটপটা নিয়ে বাড়ি চলে এলো মতিন। স্থানীয় বাজারে এসে মিশুর সাথে দেখা হয়ে গেল মতিনের। মিশু বললো, "পিসি কোথায় পালিরে মতিন?" মতিন ওকে সংক্ষেপে ঘটনাটা খুলে বলল। তখন ও যার পর নাই বিস্মিত এবং মর্মাহত হলো। মিশু বলল- "এরকম একটা ঘটনা তোর সাথে হতে পারে এটা আসলে আমার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে। ছি-ছি! তোর মত মাটির মানুষের কাছ থেকে সামান্য একটা জিনিস নিয়ে ও এরকম একটা কুমা কাজ করবে সেটা আমি আসলে কোনো ভাবেই মেনে নিতে পাচ্ছি না। অন্য মানুষের সাথে করতে পারলেও, অন্তত তোর সাথে এমনটা করা কোনো ভাবেই ওর উচিত হয়নি।" মতিনের কথার সুযোগ না দিয়ে ও কথা চালিয়ে গেল, "তুই না একসময় ওর সময় নিয়ে পড়াতিস যা দেখে আমাদের হিংসে হতো। এত কাছের মানুষ, ঢাকায় হারিয়ে গেলে এত চোখের পানি ফেলে কেঁদেছিস - আর সেই মানষটারে এইভাবে অপমান করবে, সেটা আমার মাথায়ই আসে নারে ভাই।" ভ্যানের পেছনে বসে মতিন মিশুর কথা কান পেতে শুনছে আর অপলক দৃষ্টিতে শৈশবের সেই স্মৃতিময় দিনগুলোতে চোখ বুলাচ্ছে। মিশু একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো,"তুই যাই বলিস দোস্ত, এটা কোনোভাবেই আমি মেনে নিতে পারছি না।" ওর মনের আক্ষেপ আফসোস মনের অভিপ্রায় সমস্ত কিছু অবলোকন করে মতিন বুঝলো, ও যে আচরণ করছে, সেটা বেয়াদবের চরম সীমা অতিক্রম করেছে। যেখানে ও ভুক্তভোগী নয় তার প্রতিক্রিয়া এমন, তাহলে ঐ জায়গায় মতিনের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়। এই কথাটা মিশু বাড়ি এসে তাতের আরেক বন্ধুর সাথে শেয়ার করলো। ওরও একই ভাব প্রকাশ করল। আসলে ও যে কাজটা করেছে, এত ঘৃণিত কাজ করেছে সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আর এই কাজটা ও করলো কিভাবে? টাকা না হলে কম্পিউটার দিবে না, এই কথাটা শুনে বন্ধু তমিজও অনেক চটে গেল আর বলতে লাগলো যে, ও কাজটা একদমই ঠিক করে নায়। রাহাত কাজটা ঠিক করে নায়।
চাকরি লাইফে মতিনের যখন জেলা শহরে পোস্টিং। হঠাৎ করে রাহাত একদিন ঐ শহরে চলে এসেছে। সেই শহরে এসে মতিনকে ফোন দিয়ে বলছে, দোস্ত, আমি তো তোর শহরে। মতিন বলছে, এখানে কেনো আসছিস? ও বলল, এসে বলবানে। আচ্ছা, তুই তাহলে আয়। দুই জন মিলে দুপুরের খাবার খেতে খেতে কথা বলবানে। ও মতিনের কাছে আসলো । ওর সাথে নিয়ে মতিন পাশের এক হোটেলে গেলো। হোটেলে বসে ও খেতে খেতে বলল, দোস্ত, এখন তো চাকরি-বাকরি পাওয়া খুব টাফ হয়ে যাচ্ছে। তা আমার নানা যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা ছিল। নাতি নাতনিদের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা আছে। এজন্য মাকে বলে আমি আমার সার্টিফিকেট এফিডেভিট করতে শিক্ষা বোর্ডে এসেছি। মানে, সার্টিফিকেটে আমার মেয়ের নাম নেই। আমার বড়মার নামে আছে। এখন আমি এফিডেভিট করে আপন মেয়ের নামটা বসাতে চাই। এতে আশ্চর্য হয়ে মতিন বলল, "তুই অবশেষে এত নিচু মনের মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছিস ! চাকরি পাওয়ার লোভে শেষমেষ নিজের মায়ের নামটা পর্যন্ত চেঞ্জ করছিস?" ওর সাথে মতিন যখন গল্প করছে তখন ওই হোটেলেরই টিভিতে হঠাত্ তখনই সংবাদ ভেসে আসলো, কোটা আন্দোলনে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সংসদে ঘোষণা দিলেন যে, কোন প্রকারের চাকুরিতে আর কোটাই থাকবে না। তখন তাত্ক্ষণিক ভাবে মতিনের মনে এমন একটা উপলব্ধি ভেসে এলো যে, এই ঘোষণা অন্য কোনো কারণে নয়: এটা সাক্ষাত্ রাহাতের ঐ স্বার্থপরতার কথা জেনেই পরম ঈশ্বরের মারফতেই ঘোষণাটা আসছে। তা না হলে, সাতে সাতে এরকম ঘোষণা আসতে পারে না। যে স্বার্থপরতায় সাড়া দিয়ে নিজের মায়ের নামটি পর্যন্ত চেঞ্জ করতে চাই, সে ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘোষণা আসতেই পারে। এটা জাস্ট মতিনের মনের ধারণা, আসলেই সত্যি কিনা সেটা আল্লাই ভালো জানে । এরকম অসংখ্য স্বার্থপরতার বিষয় চলে আসে, যেটা আসলে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। একদিন মতিনের এক কাছের মানুষ মরে যাওয়ার পরে, মতিন অবাক হয়ে গেলো তার কথা শুনে! মতিনরা তো কেঁদে-কেটে অস্থির। ও বলে, দোস্ত তুই এখানে একটু দাঁড়া আমি ওদের সাথে একটু কথা বলে আসি। মতিন বলে, "ওদের সাথে এখন কথা বলবি মানে? বুঝলাম না। কতদিন হলো ওদের সাথে তো তোর বনিবনা হয়না।" ও বলল, "তাতে কি? এখন তো ওদের লাগবে আমার। মরা দেখতে ওরা কিসে করে যাবে একটু শুনে আসি। মোটর সাইকেলে গেলে তো একটু তাড়াতাড়ি যেয়ে ঘুরে আসতে পারবো এজন্য আর কি।"
একবার মেস থেকে মতিনের মোবাইলটা হারিয়ে গেল। সখের মোবাইলটা হারিয়ে মতিন খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়ল এবং ওর তখন এত খারাপ লাগছিল যে, ভাবল; দুঃখের বিষয়টা কারো সাথে শেয়ার করলে হয়তো মনটা একটু হালকা হবে। তাই মতিন তখন ওই রাহাতকে ফোন দিলো। মতিন ভাবলো, ওর সাথে কিছু কথা বললে মনটা হালকা হবে এবং সে একটু স্বস্তি পাবে। অথচ মতিন ওকে 20/25 বার ফোন দেওয়া সত্ত্বেও ও ফোনটা রিসিভ করে নাই । ও ভেবেছে, মতিন হয়ত তার ফোনটা উদ্ধার করার জন্যই তাকে ডাকছে। বলে নেয়া ভাল, মোবাইলটা হারানোর পর মতিন যখন হতাশ হয়ে বসে আছে, তখন ওর আরেকটা পরিচিত ভাই ওই ম্যাচেই সেদিন তার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছিল। আর সেই হয়তো তখন বলেছে যে, মতিন মোবাইলটা খুয়িয়ে ভীষণ বিপদে পড়েছে। আর ও তোর এই জন্যই ডাকছে। তুই এখন আসিস না। এটা মতিনের কল্পনার কথা এবং সেটাই বাস্তব হবে হয়তো। তা যদি নাই বা হয়, তাহলে ও কিভাবে জানলো যে, মতিন ভীষণ বিপদে পড়েছে? মোবাইলটা হারিয়ে মতিন ওকে আরেকটা সিম দিয়েও প্রায় দশ বারো বার ফোন দিয়েছে, কিন্তু ও কোনোভাবেই ফোনটা রিসিভই করেনি তো করেই নি।
ম্যাচে জুতা সরানো নিয়ে কার সাথে যেন বাদানুবাদ করে, ও কোন একটা ছেলেকে যেন বেদমভাবে মেরে বসে। স্থানীয় কোন বড়ভাই তা মিটিয়ে দিলে, ভাইটি ওর কাছে পারিশ্রমিক হিসেবে টাকা দাবি করে। তখন ও তুরুপের তাস স্বরূপ ঐ মতিনের নাম্বারটাই দিয়ে দেয়। মাস্তান টাইপের সেই বড়ভাই তখন মতিনের নাম্বারে কল দিয়ে বলে, রাহাত দূরে থাকায় ও টাকাটা তোকে দিয়ে দিতে বলেছে। ও ম্যাচে আসলে যথাসময়ে তোকে টাকাটা দিয়ে দেবে। রাহাত যে বড় ভাইকে টাকা দিতে বলেছে সেটা ফোন দিয়ে কনফার্ম হবার জন্য মতিন বারংবার রাহাতের ফোনে কল ঢোকানোর চেষ্টা করে। অথচ রাহাত তার মোবাইলটা বন্ধ রেখেছে তো রেখেছেই। মাতাল বড়ভাই টাকার জন্য মতিনকে ছিড়ে খাচ্ছে। তাই শেষমেষ মতিন কোনো উপায় অন্তর না দেখে তার পকেটে থাকা ঢাকায় পরিক্ষা দেবার জন্য রেখে দেওয়া দুইশো টাকা অসহায়ের মতো দিয়ে দেয় । অথচ রাহাত ম্যাচে ফিরলে মতিন ঘটনাটা খুলে বল্লেও, টাকাটা আর মতিনকে কোনো রকম দেয় না এবং ও বলে কি, টাকা কি তোকে আমি দিতে বলেছি?
কোচিং দেবে বলে অভিভাবক হিসেবে মতিনকে সাইকেলের পেছনে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায় এবাড়ি ওবাড়ি। অথচ কোচিং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয় সেই সমস্ত বন্ধুদের যারা ভালো চোখে মুখে কথা বলতে পারে তাদের। আবার বন্ধরাও ওকে ফোন দিয়ে ডাকলে, ও প্রথমে হিসাব করে দেখে, বাইরে বেরোলে মূলত ওর লাভটা কি হবে! তারপর ও সিদ্ধান্ত নেয় ও আসলে বাইরে আসতে পারবে কিনা। তাছাড়া যদি সেটা ওর স্বার্থের পরিপন্থী হয় তাহলে তখন ও বলে দেবে যে, সে অমুক কাজে আটকে আছে; এখন সে বাইরে আসতে পারছে না। আবারো যদিওবা বাইরে আসে তখন ওর স্বার্থ টুকু যখন পরিপূর্ণ হয়ে যায়, তখন ও আবার এমন অজুহাত দিয়ে বাড়িতে ফিরে যাবে, তাতে বন্ধুরা অন্তত না বলতে পারবো না। অজুহাত গুলো এমন হয় যেমন, আমার টয়লেটেরের বেগ এসেছে, ওয়াশরুমে যেতে হবে বা ছাত্রীকে পড়াতে হবে অথবা প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
চাকরি না পাওয়া এক সন্তানের বাবা রাহাতের যখন চরম দূরাবস্থার মধ্যে দিন কাটছে তখন সে মনের কথাগুলো শেয়ার করার জন্য একদিন মতিনকে ডাকলো। মতিন এখন মোটামুটি ভালো একটা চাকরি করে। তাই সে সময় করে এক ছুটিরদিন মতিনের সাথে দেখা করতে আসলো। নানান স্মৃতি রোমন্থন করার পরে মতিন রাহাতকে জিজ্ঞাসা করল, "আচ্ছা, তুই সব সময় এরকম বেপরোয়া হয়ে মেয়েদের পেছনে পড়ে থাকতিস ক্যান?" রাহাত এতদিনে মতিনের জিজ্ঞাসায় অন্তত মনের সত্য কথাটা আজ খুলে বলল, "আসলে মতিন ভাই, তুমিতো জানো আমি দেখতে আমার বন্ধুদের মতো অতটা হ্যান্ডসাম না; তাই বন্ধুরা যখন এক একটা সুন্দরী মেয়ের সাথে প্রেম করতো আর আমার সামনে মিষ্টি মিষ্টি প্রেমালাপ করত তখন ঐটা দেখে আমার ভিতরে ভিতরে খুবই ঈর্ষা হতো, জ্বলে পুড়ে আমি ছাই হয়ে যেতাম। তাই ভাবতাম, ওদের মত আমিও যদি প্রেম করতে পারতাম এবং সুন্দর দুষ্টু মিষ্টি প্রেমালাপে ওদের চাইতেও মধুর সময় পার করতে পারতাম, তাহলেই বোধহয় জীবনটা স্বার্থক হতো! কিন্তু আমার মিষ্টি কথার জাদুতে মেয়েরা প্রাথমিকভাবে মশগুল হলেও, সাক্ষাতে যখন কথা হত তখন আমার ফিগার দেখে পরক্ষণেই সবাই আমার সাথে আর যোগাযোগ রাখত না। ফলে পরবর্তীতে আমি প্রেম করার জন্য আরো বেশি ক্রেজি হয়ে পড়তাম। মূলত নানা অসহায়ত্ব লাঘবের জন্যই আমার মনটা সবসময় কারো না কারো সঙ্গ পেতে সবসময় আনচান করত। মজার ছলে প্রেম করলেও শেষটা হতে আর রেহাই পায়নি পরিস্থিতির শিকার হয়ে এক সময় তাকে বিয়েই করতে হলো। মতিন বলল, "তুই যখন মেয়েটাকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে চলে যাস তখন তোর নাম্বারে আমি কিন্তু অনেকবার চেষ্টা করে করে একবার ফোন ঢুকাতে পারছিলাম। কিন্তু তুই ফোনে এমন এটিচিউডে কথা বলেছিলি যা খুবই অদ্ভুত ছিল এবং অসামাজিক ছিলো। এমন ধমকের সুরে কথা বলছিলি মনে হচ্ছিল, তুই বরং আমাকে কোনদিন চিনিসই না।" তখন রাহাত বলল, "ওই পরিস্থিতিতে কার সাথে কিভাবে কথা বলেছি আসলে আমি তা স্মরণ করতে পারছি না যে মতিন ভাই।"
রাহাত যত চালাক ছিল, তার চাইতেও বেশি চালাক ছিল তার বন্ধুরা। আর এজন্যই রাহাতকে তারা সবসময় হাতের লাঠি হিসেবে ব্যবহার করতো। কখনো রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে, কখনো কাউকে হেনস্থা করতে অথবা যেকোনো মারামারির বা অনৈসলামিক কাজের ক্ষেত্রে রাহাত ছাড়া তাদের চলবেই না। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে রাহাতকে তারা নায়কের আসনে বসিয়ে দিত। আর ব্যস! তাতেই মোটামুটি কাজ হয়ে যেত। কিন্তু মতিন কখনোই একরম করতো না। সে সব সময় রাহাতের ভালই চাইতো। কিন্তু রাহাত সেটা এখন বুঝলেও; সময়কালে কখনো বোঝে নাই অথবা বুঝতে চাইও নাই। এখন তার আর সেই যৌবন নেই, জৌলুস নেই, চাকরি নেই এবং যার ফলে তথাকথিত সেই ফ্রেন্ডদের আনাগোনাও নেই। জীবনে চরম বাস্তবতায় ও এখন নির্বিকার মানুষ হয়ে বসে আছে। মানুষ আসলে সময় থাকতে কিছু বুঝতে চাই না, আর যখন বোঝে তখন আর তার ফিরে যাওয়ার উপায় থাকে না।
রাহাতের একবার করানো হলো। এতে সে ভীষণ অসুস্থতায় ভেঙে পড়ল। এরপর তার সেই বিবাহিত বউটাও করোনায় আক্রান্ত হল। হলে দুজনেই হাসপাতলে। এতদিনে যেকোন বিপদে রাহাত রবিনকে ফোন করে। কিন্তু কেন জানি সে এইবার রবিনকে এই অসুস্থতা বা নির্মম পরিস্থিতির কথা জানাতেই চায় নাই। এদিকে রোবিনও ভাবছে, রাহাত যদি ফোন করে না ডাকে; তবে কোনোমতেই সে ওখানে যাবে না বা তাকে সাহায্য করার প্রয়াসে ওখানে উপস্থিত হবে না। কিন্তু রাহাতের একমাত্র ছেলে রোহান পিতা-মাতার করনা-আক্রান্তের কারণে তাদের কাছে ঘেঁষতেই দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি রাহাত যে বাসাতে ভাড়া থাকত সে বাসার কোন পরিবারই ঐ ছেলেকে রাখতে চাচ্ছে না। রাহাত বাড়িতে ফোন করে সৎ ভাইয়ের বউকে তা ছেলেটাকে রাখার কথা বলে। কিন্তু তারাও রাখতে রাজি হয়না। আপনজন যখন ছেলেটাকে রাখতে রাজি হয়না, তখন বাসার পাশের একজন গ্রামের পরিচিত লোক ছেলেটাকে রাখে। কিন্তু সেখানেও দুই দিনের বেশি ওরা আর রাখতে চায় না। এমন একটা কঠিন মুহূর্তে রাহাত অবশেষে একান্ত নিরুপায় হয়ে হসপিটালের মেঝে থেকে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে রোবিনকে ফোন দেয়। প্রথমে রাহাত কান্নায় বাকরুদ্ধ হয়ে কথা বলতে না পারায় ফোনটা তার স্ত্রী শেফালির হাতে দিয়ে দেয়। শেফালীও কান্নায় বিগলিত হয়ে রোবিনকে বলে, "রবিন ভাই, আমার ছেলেটাকে একটু বাঁচান। আমাদের করনা হতে দেখে ওকে কেউ গ্রহণ করতে চাচ্ছে না। আপনার কাছে আমার ছেলেটাকে একটু রাখেন না ভাই। রোবিন একজন স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ী। আলাদা দোকান না থাকায়, সে বাড়িতে বিভিন্ন ত্রিপিচ, ছিট কাপড় এগুলো নিয়ে আসে আর বিক্রি করে। এবার লকডাউনে মার্কেটে যাবার সুযোগ না থাকায় ঈদ মৌসুমে রবিনেন ভালোই বেচা বিক্রি হচ্ছিল। কিন্তু কাস্টমাররা যখন শুনলো, রাহাতের ঐ ছেলেটা রবিনের বাড়িতে আসছে; তখন আর আর ঐ বাড়ির ত্রিসীমানায় কেউ পা রাখে না। দেখা গেল, রোবিনের আগে যে পরিমাণ বেচা বিক্রি হতো সেটা এখন একবারে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। অর্থাত্ এখন একটা মুরগি পর্যন্ত রোবিনের বাড়িতে প্রবেশ করে না। ফলে তাঁর ব্যবসাটা একদম লাটে উঠে গেল বললেই চলে। শুধু কি তাই? হাসপাতালের খাবার পৌঁছে দেয়ার সমস্ত দায়িত্ব যেন ঘাড়ে তুলে নিল রবিন। এরপর এভাবে অনেক সেবা শুশ্রূষা করার পর ওরা দুজনই আল্লার অশেষ রহমতে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে এলো। প্রতিদিন ভাত দেওয়ার জন্য রাহাতের কাছে রোবিনের অনেকগুলো খাবারের বাটি জমা হয়ে গেল। রোবিন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একটা ছেলে। এতগুলো খাবারের বাটি তার নতুন করে কেনা তার কাছে অপচয়ই মনে হলো। কারণ রবিনের ছেলেটা মাদ্রাসায় পড়ে। তার জন্য নিয়মিত ভাত নিয়ে যেতে হয়। এজন্য সে রাহাতকে ফোনে বলে, বাটিগুলো একটু দিয়ে যাস তো দোস্ত। রাহাত বলে, দেরি কর দোস্ত। বাটিগুলো একসময় আমি নিজে গিয়েই দিয়ে আসবো দোস্ত। এরপর একদিন হঠাৎ করে রোবিনকে ফোন দিয়ে বলে, তুই কি বাসায় আছিস দোস্ত? রবিন বলল, হ, আমি বাসায়ই আছি। "তাহলে তুই বাসায়ই থাক। আমি আধা ঘন্টার মধ্যেই আসছি তোর বাসায়।"
Comments
Post a Comment